শিক্ষাব্যবস্থার ইসলামী রূপরেখা... (1) Overview of Islamic education
আমাদের দেশে ইসলামী রাষ্ট্র কথাটি যেরূপ কুয়াশাচ্ছন্ন, ‘ইসলামী শিক্ষা’ কথাটিও তেমনি অস্পষ্টতার অন্ধকারে নিমজ্জিত। এদেশে প্রচলিত প্রাচীন পদ্ধতির মাদরাসা শিক্ষাই যদি ইসলামী শিক্ষা হয় তাহলে প্রতিভাবান ছাত্রদের এ শিক্ষার দিকে আকৃষ্ট হওয়ার কোন কারণ নেই এবং সমাজে উন্নতি ও মর্যাদা লাভের উদ্দেশ্যে কোন অভিভাবকই তাদের সন্তানদের এ শিক্ষা দিতে রাজি হবে না। আর ইংরেজী প্রবর্তিত আধুনিক শিক্ষাই যদি আদর্শ শিক্ষা বলে প্রচারিত হয় তাহলে এ শিক্ষার ফল দেখে কোন ইসলামপন্থী লোকই সন্তুষ্টচিত্তে এ ধরনের শিক্ষাকে সমর্থন করতে পারে না। যারা ইসলামী মূল্যমান ও মূল্যবোধকে শ্রদ্ধা করে এবং ভবিষ্যৎ বংশধরদের দুনিয়া ও আখিরাতের কামিয়াব দেখতে চায়, তারা প্রচলিত দুটি শিক্ষাব্যবস্থার কোনটিকেই আদর্শ শিক্ষা বলে স্বীকার করতে পারে না। তাই বর্তমান যুগি দুনয়াতে শান্তি ও মর্যাদর সাথে জীবন যাপন করে আখিরাতের আদালতে মুসলিম হিসেবে আল্লাহর সম্মুখে হাজির হওয়ার যোগ্যতা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে যেসব অভিভাবক ছেলে-মেয়েদের জন্য উপযুক্ত শিক্ষা দ্বারা পার্তিব কোন যোগ্যতা সৃষ্টি হয় না। আর আধুনিক শিক্ষায় ইসলামী চরিত্র সৃষ্টিই অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই আধুনিক দুনিয়ার উপযোগী ইসলামী শিক্ষা কোন্ ধরনের হবে তা আমাদের গভীরভাবে চিন্তা করা দরকার। সরকারী পর্যায়ে এ ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু না হলেও যাতে আগ্রহশীল লোকদের প্রচেষ্টায় একটি আদর্শ ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা ক্রমন্বয়ে গড়ে তোলা যায়, সেদিকে ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধাশীল লোকদের দৃষ্টি আকর্ষন করার উদ্দেশ্যেই এই আলোচনার অবতারণা করছি।
যেহেতু বর্তমান শিক্ষাসংকট থেকে মুক্তিলাভের আকঙ্ক্ষায়ই ইসলামী শিক্ষার রূপ সম্পর্কে আলোচনা করছি, সেহেতু বর্তমান পটভূমিকে রেখেই আমাদেরকে অগ্রসর হতে হবে। তাই প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই আলোচনা করতে হবে। এ ব্যাপারে প্রত্যেক চিন্তাশী ব্যক্তি বিশেষ করে আমাদের শিক্ষাবিদগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করার উদ্দেশ্যে কয়েকটি মৌলিক বিষয়ের অবতারণা করা অত্যন্ত জরুরি মনে করি। প্রথমত, শিক্ষা বলতে কি বুঝায়,তা পরিষ্কার হওয়া দরকার। দ্বিতীয়ত, মানুষের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা রচনাকালে মানুষের সঠিক পরিচয় সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। মানুষকে দেহসর্বস্ব জীব মনে করলে শিক্ষাব্যবস্বথায় আত্মার বিকাশ লাভের কোন বন্দোবস্তই থাকবে না। আবার মানুষের বস্তুগত প্রয়োজনের দিকটি উপেক্ষা করে একমাত্র আত্মিক উন্নতির উদ্দেশ্যে যে শিক্ষা পদ্ধতি কায়েম হবে তা মানুষের পক্ষে কল্যাণকর হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। তৃতীয়ত, যে ধরনের লোক তৈরি করা শিক্ষার উদ্দেশ্য হিসেবে নির্ধারিত হবে, সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাকে তদনুযায়ী পুনর্গঠন করা প্রয়োজন। শিক্ষার উদ্দেশ্যের সাথে জাতীয় জীবনাদর্শের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। যে আদর্শকে জাতির লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারত করা হবে, শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে সে আদর্শের উপযোগী চরিত্রই গঠন করতে হবে।
চতর্থিত, প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার মূল ত্রুটি কোথায়, তা সঠিকরূপে অবগত না হলে শিক্ষা পুনর্গঠনের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। কেননা রোগের
প্রকৃত কারণ না জানলে নির্ভুল চিকিৎসা কিছুতেই সম্ভব
নয়। এই চারিটি বিষয়ের মীমাংসা শিক্ষা পুনর্গঠনের ব্যাপারে অত্যন্তগুরুত্বপূর্ণ এসব বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ না
করে শিক্ষার বাহ্যিক কাঠামো, আধুনিক উন্নত শিক্ষাপদ্ধতির প্রচলন, শিক্ষার স্তরবিভিাগ, শিক্ষার মানোন্নয়ন ইত্যাদির শ্রুতিমধুর ও মুখরোচক আলোচনা নিতান্তই অর্থহীন। রোগ নির্ণয় ও নির্ভুলি চিকিৎসার বন্দোবস্ত না করে
রোগীকে যত সুন্দরভাবেই রাখা হোক এবং তই সেবা-শুশ্রুষা করা হোক, রোগীর অবস্থার
উন্নতি এসব বাহ্যিক ব্যবস্থা দ্বারা মোটেই সম্ভব নয়। সুচিকিৎসার সাথে এসব বাহ্যিক ব্যবস্থা যুক্ত হলে উদ্দেশ্য সফল হবার পূর্ণ সম্ভাবনা আছে।
শিক্ষা কাকে বলে?
শিক্ষার সংজ্ঞা
সম্বন্ধে শিক্ষাবিজ্ঞানীদের দার্শনিক জটিলতা থেকে মুক্ত হয়ে
জনসাধারণের (Layman’s) বোধগম্য ও সরল আলোচনাই প্রয়োজন। আমাদের চারপাশের
যেডসব জীব-জানোয়ারের সাথে আমাদের
ঘনিষ্ঠ পরিচয় তাদের মধ্যে শিক্ষার কোন কৃত্রিম প্রচেষ্টা আমরা দেখতে পাই
না। স্রষ্টা তাদের স্বভাবের মধ্যেই প্রয়োজনীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
এরা বিচার-বিবেচনা করে, পরামর্শ ও গবেষণা চালিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে শিক্ষার
কোন ব্যবস্থা করে না। এদের সহজাত বৃত্তির (Instinct) তাগিদেই প্রাকৃতিক
নিয়মে তারা প্রয়োজনীয় জ্ঞান লাভ করে থাকে। কোন উস্তাদের কাছে সবক
নিয়ে তারা শিক্ষা লাব করে না। বয়স্ক জীবেরা ছোটদের শিক্ষার জন্য কোন বিদ্যালয়
প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করে বলেও আমরা জানি না। জীবশিশুদের পিতামাতাকে
তাদের সন্তান-সন্ততির উপযুক্ত শিক্ষার জন্য পেরেশান হতেও দেখা যায়
না।
কিন্তু তাই বলে কি
তাদের শিক্ষার কোন প্রয়োজন নেই? প্রত্যেক জীবেরই জীবন ধারণের
উপযোগী খাদ্য ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হয়। নিতান্ত বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই
তাদেরকে কাজ করতেও আমরা দেখতে পাই। জীবশিশু তার পূর্ণ বিকাশ লাবেল
উপযোগী গুণাবলিও অর্জন করে থাকে। এসব মেনে নেওয়া সত্ত্বেও আমরা স্বীকার
করতে বাধ্য যে, মানুষের ন্যায় ‘বুদ্ধি’ প্রয়োগ দ্বারা
ইচ্ছাকৃতভাবে চেষ্টা করে তাদেরকে শিক্ষা লাভ করতে হয় না।
মানবশিশুর বিকাশ, এমনকি
অস্তিত্ব পর্যন্ত তার পিতামাতা এবং অন্যান্য শিক্ষকের
উপর যেরূপ নির্ভরশীল, অন্যান্য জীবের মধ্যে সেরূপ নির্ভরশীতার প্রয়োজন
হয় না। মানবশিশু আগুনকে খেলার জিনিস মনে করে তাতে হাত দেয়, নিজের পায়খানাকে
হালুয়ার মতো মুখে দেয়। কিন্তু কোন বিরাড়শিশুকে এরূপ করতে দেখা যায়
না। যে কুকুর মানুষের মলকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে, তার
শিশুকেও কোনদিন নিজের পায়খানা মুখে দিতে দেখা যায় না। মানুষের
শৈশবকাল
এতো দীর্ঘ যে, পনেরো-বিশ বছর পর্যন্ত তাকে পিতাতামা, শিক্ষক ও অভিভাবকের তত্ত্বাবধানে উপযোগী গুনাবলি অর্জন করতে হয়। অথচ
মানুষের চেয়ে দীর্ঘজীবী প্রাণীদের বেলায়ও এরূপ নির্ভরশীলতার প্রয়োজন হয় না। সুতরাং দেখা যায় যে, মানবশিশুকে ইচ্ছাকৃতভাবে কৃত্রিম প্রচেষ্টা দ্বারা যা শিক্ষা দিতে হয়, অন্যান্য জীবশিশু তা সহজাত বৃত্তি দ্বারা আপনা-আপনিই লাভ করে থাকে। কিন্তু মানুসের যাবতীয় জ্ঞানের জন্যই শিক্ষার প্রয়োজন। এদিক দিয়ে বিবেচনা
করলে মানুষের শিক্ষার সংজ্ঞা নিম্নরূপ: “প্রয়োজনীয় গুণাবলি ও জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত
ব্যবস্থার নামই শিক্ষা।” এ ধরনের শিক্ষা একমাত্র মানুষেরই
প্রয়োজন। অন্যান্য জীব-জানোয়ার এ ঝামেলা থেকে মুক্ত। কোন্টা খাওয়া ঠিক ও কোন্টা খাওয়া ঠিক নয়, তা জানার জন্য ছাগশিশুর নাসিকাযন্ত্রের সহজাত ক্ষমতাই যথেষ্ট। কিন্তু মানবশিশুকে তা বড়দের নিকট থেকে শিখতে হয়।
শৈশবকালে মানুষও সহজাত বৃত্তি দ্বারা পরিচালিত হয় বটে; কিন্তু যতই তার বুদ্ধি ও ববেচনাশক্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে, ততিই উক্ত সহজাত বৃত্তি বুদ্ধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। মানব চরিত্র গঠনের প্রাথমিক স্তরে বালক-বালিকারা ইচ্ছাকৃতভাবে জ্ঞানার্জন করার চেষ্টা না করলেও বড়দের ইচ্ছাকৃত চেষ্টার ফলেই তখন তারা শিক্ষা লাভ করে। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে তারা নিজেরাই চেষ্টা করে জ্ঞানার্জন করতে অভ্যস্ত হতে থাকে।
শৈশবকালে মানুষও সহজাত বৃত্তি দ্বারা পরিচালিত হয় বটে; কিন্তু যতই তার বুদ্ধি ও ববেচনাশক্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে, ততিই উক্ত সহজাত বৃত্তি বুদ্ধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। মানব চরিত্র গঠনের প্রাথমিক স্তরে বালক-বালিকারা ইচ্ছাকৃতভাবে জ্ঞানার্জন করার চেষ্টা না করলেও বড়দের ইচ্ছাকৃত চেষ্টার ফলেই তখন তারা শিক্ষা লাভ করে। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে তারা নিজেরাই চেষ্টা করে জ্ঞানার্জন করতে অভ্যস্ত হতে থাকে।
মানুষের পরিচয়
মানুষ সম্বন্ধে
সঠিক ধারণা ব্যতীত যদি শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করা হয় তাহলে শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য কিছুতেই সফল হতে পারে না। তাই মানুষের প্রকৃত
পরিচয় সম্পর্কে যুক্তিপূর্ণ আলোচনার প্রয়োজন। মানুষ সৃষ্টিজগতের বহু রহস্য উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে এবং প্রত্যেক যুগেই বস্তুজগতের বিভিন্ন শক্তিকে নিজের
উপকারে ব্যবহার করেছে। কিন্তু ওহীর জ্ঞান ব্যতীত এবং নবীদের শিক্ষা ব্যতীত কোন কালেই মানুষ তার
নিজের প্রকৃত পরিচয় লাভ করতে সক্ষম
হয়নি।
আধুনিক বিজ্ঞান মানুষকে এতো বিপুল শক্তির অধিকারী করেছে যে, মানুষ আজ পাখির চেয়েও দ্রুত উড়তে সক্ষম এবং দ্রুততম প্রাণীর চেয়েও অধিকতর বেগে চলার উপযোগী যানবাহনের অধিকারী। এমনকি গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে বিচরণের ক্ষমতায়ও ভূষিত হয়েছে। কিন্তু ‘প্রকৃত মানুষ’ হিসেবে দুনিয়ায় জীবন যাপন করার উপযোগী শিক্ষা থেকে আধুনিক মানুষ বঞ্চিত রয়ে গেলো।
এর মুল কারণ এই যে, মানুষ নিজেকে ভালোভাবে চিনতে সক্ষম হয়নি। শুধু বিবেবুদ্ধি প্রয়োগ করে মানুষ নিজেকে চিনতে অক্ষম বলেই মানুষের মহান স্রষ্টা রাসূলের মারফতে যুগে যুগে মানুষকে আত্মজ্ঞান দান করেছেন। তাই মানুষের প্রকৃত পরিচয় পেতে হলে আমদেরকে কুরআন মাজীদের নিক ‘ধরনা’ দিতে হবে।
চলবে.........আধুনিক বিজ্ঞান মানুষকে এতো বিপুল শক্তির অধিকারী করেছে যে, মানুষ আজ পাখির চেয়েও দ্রুত উড়তে সক্ষম এবং দ্রুততম প্রাণীর চেয়েও অধিকতর বেগে চলার উপযোগী যানবাহনের অধিকারী। এমনকি গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে বিচরণের ক্ষমতায়ও ভূষিত হয়েছে। কিন্তু ‘প্রকৃত মানুষ’ হিসেবে দুনিয়ায় জীবন যাপন করার উপযোগী শিক্ষা থেকে আধুনিক মানুষ বঞ্চিত রয়ে গেলো।
এর মুল কারণ এই যে, মানুষ নিজেকে ভালোভাবে চিনতে সক্ষম হয়নি। শুধু বিবেবুদ্ধি প্রয়োগ করে মানুষ নিজেকে চিনতে অক্ষম বলেই মানুষের মহান স্রষ্টা রাসূলের মারফতে যুগে যুগে মানুষকে আত্মজ্ঞান দান করেছেন। তাই মানুষের প্রকৃত পরিচয় পেতে হলে আমদেরকে কুরআন মাজীদের নিক ‘ধরনা’ দিতে হবে।
No comments