Breaking News

১৬ আগস্টের মধ্যে পোশাকশ্রমিকদের বোনাস দেয়ার নির্দেশ

শিক্ষাব্যবস্থার ইসলামী রূপরেখা...(2) Overview of Islamic education





কুরআনে মানুষের পরিচয়
কুরআন অন্যান্য জীবের সাথে মানুষের যে ব্যবধা নির্দেশ করে তা এই যে, ‘মানুষ নৈতিক জীব’ আর অন্যান্য জীব নৈতিকতার বন্ধন থেকে সম্পূর্ণ ‍মুক্ত। ভালো ও মন্দ, সৎ ও অসৎ, সত্য ও মিথ্যার বিচার করার ক্ষমতা মানুষ ছাড়া আর কোন জীবের মধ্যে আমরা দেখতে পাই না। মিথ্যার বেসাতিই যার সম্বল, সে মানুষটিও ‘মিথ্যা বলা অন্যায়’ বলে স্বীকার করে। মিথ্যা বলাকে ভালো কাজ মনে করলে সে ‘মিথ্যুক’ উপাধিতে ভূষিত হওয়া পছন্দ করতো। ‘চুরি করা খারাপ’ এ কথা স্বীকার করে বলেই চোর প্রকাশ্যে না গিযে গোপনে চুরি করতে যায়। ভালোমন্দের এই বিচারজ্ঞানই মানুষকে অন্যান্য জীব থেকে পৃথক করেছে। যারা এঈ নৈতিক দিককে উন্নতি করার চেষ্টা করে না, কুরআন তাদের সম্বন্ধে মন্তব্য করে যে, “তারা পশুর ন্যায়; বরং পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট।” নৈতিকতার উন্নতি ব্যতীত মানুষ তার যাবতীয় শক্তি যখন ব্যবহার করে তখন সে পশুর চেয়েও অনিষ্টকর ও ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। চিন্তাশক্তিও বুদ্দি মানুষের বিরাট অস্ত্র। এ অস্ত্রের সাহায্যে শারীরিক আকারে ক্ষুদ্র হয়েও সে বিরাট বপুবিশিষ্ট হাতীর উপর কর্তৃত্ব করে। কিন্তু নৈতিকতার বিকাশ না হলে এই বুদ্ধিশক্তিকেই সে মানব জাতির অকল্যাণে প্রয়োগ করে। কিন্তু নৈতিকতার অবনতির ফলে যখন কেউ মিথ্যা বলে তখন সে কুকুরের চেয়েও অধম হয়ে পড়ে। কেননা কুকুর মিথ্যা বলতে পারে না। তাই বস্তুগত শক্তির সঠিক ব্যবহার নৈতিকতার উপরই নির্ভরশীল। একটি ছুরি নৈতিকতা সম্পন্ন ব্যক্তির হাতে ব্যবহৃত হলে তা মানুষের উপকারই করবে। কিন্তু নৈতিকতার অভাব হলে এ ছুরিই তাকে ডাকাতে পরিণত করবে। নৈতিকতার বিকাশ ব্যতী আধুনিক বিশ্ব এতো প্রচণ্ড বস্তুরশক্তির অধিকারী হয়েছে, বলেই আজ মানব জাতি এতো বড় সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। আণবিক শক্তি ও মহাশূন্যের ব্যবহার আজ মানব জাতির অস্তিত্বকে শঙ্কুল করে তুলেছে। কেননা এসব শক্তি নৈতিকতায় ভূষিত মানবের হাতে ব্যবহৃত হচ্ছে না, নৈতিকতাহীন দানবের হিংস্র থাবা দ্বারাই এদের ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।
কুরআন হাত. পা, চোখ-কানবিশিষ্ট শরীরটিকে প্রকৃত মানুষ মনে করে না। কুরআনের মতে, এ দেহ সৃষ্টির বহু পূর্বে মানুষ সৃষ্টি হয়েছে। কুরআনের পরিভাষায় সেই মানুষটিই হলো ‘রূহ’ বা আত্মা। এ আত্মাই নৈতিকতার আধার। রূহকে উন্নত করার ব্যবস্থা না করলে এ শরীর পশুর ন্যায় ব্যবহার করবে। শরীরের যত সব বস্তুগত দাবি আছে তা পূরণের জন্য মানবদেহ সকল সময়ই ব্যস্ত। পেট খালি হলেই সে খাদ্যের জন্য ব্যস্ত হয়। মানুষ সেই খাদ্য চুরি করে আনলো, না পরিশ্রম করে অর্জন করলো সে বিষয়ে পেটের কোন মাথাব্যাথা নেই। তার খাদ্যের প্রয়োজন। অন্যায়ভাবে খাদ্য এনে দিলেও সে নিশ্চিন্তে খেতে থাকে। কিন্তু তখন রূহ বলতে থাকে যে, কাজটা অন্যায় হলো। গৃহপালিত পশু রজ্জু ছিঁড়ে নিজেরই দয়ালু মনিবের সাজানো বাগান খেতে একটুও দ্বিধাবোধ করে না। নৈতিকতার বন্ধন ছিঁড়তে পারলে মানবদেহও তেমনি একটি পশুতে পরিণত হয়। মহানবী (স) তাই নৈতিকিতাসম্পন্ন মানুষকে এমন এক ঘোড়ার সাথে তুলনা করেছেন, যা রজ্জু দ্বারা এক খুঁটির সাথে আবদ্ধ। এ ঘোড়াটি যেমন স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে পারে না তেমনি মানুষ স্বাধীনতাও নৈতিকতার রজ্জু দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাই কেবল রজ্জুর সীমা পর্যন্তই সে স্বাধীনভবে চলাফেরা করতে সক্ষম।
দেহ ও আত্মার দ্বন্দ্ব
উপরিউক্ত আলোচনা ছাড়াও প্রত্যেক ব্যক্তিই তার বাস্তব অভিজ্ঞতা হতে এ কথা স্বীকার করতে বাধ্য যে, মানুষের আত্মার সাথে তার দেহের এক চিরন্তন দ্বন্দ্ব লেগে আছে। মানুষ অনেক নৈতিকতা বিরোধী কার্যকলাপ হতে বেঁচে থাকতে চেষ্টা করে কিন্তু অনেক সময় দেহের তাগিদের নিকট পরাজয় বরণ করে। এ দ্বন্দ্বে দেহের জ্বালায় অস্থির হয়েই একশ্রেণীর মানুষ নৈতিকতার চাপে বৈরাগী হওয়ার প্রেরণা লাভ করে। তারা ‘দরবেশ’ ও ‘সন্যাসী’ হলেও মানুষের মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হয়। তারা নির্জীব পাথর ও নিশ্চল গাছের ন্যায় জীবন-যাপন করে মনুষ্যত্বের উচ্চস্থান থেকে পতিত হয়। আবার অন্যদিকে অধিকাংশ লোক দেহের নিকট পরাজিত হয়ে আত্মাকে পঙ্গু করে পশুর ন্যায় জীবনযাপন করে। কুরআনে মানুষকে এ দ্বন্দ্বে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য যে বিধান দিয়েছে, তা দেহের সকল দাবিকে নৈতিকতার সীমার ভেতরে পূরণ করতে সাহায্য করে। দেহের দাবিকে অস্বীকার করার বিরুদ্ধে কুরআন বলে, “বৈরাগ্য সাধনের নীতি মানুষ নিজেই আবিষ্কার করেছে, আমরা তাকে এ নির্দেশ দান করিনি।” (সূরা হাদীদ: ২৭)
আত্মা ও দেহের দ্বন্দ্বে দেহকে অস্বীকার করার বৈরাগ্য নীতি যেমন মানুষের উপযোগী নয়, তেমনি আত্মাকে পরাজিত করে পশুর ন্যায় ভোগবাদ ও ভোগবাদের মাঝামাঝি মনুষ্যত্বের সিরাতুল মুস্তাকীমই কুরআনের শেখানো পথ। তাই কুরআনর মতে মানুষ আত্মাহীনও নয়, দেহহীনও নয়; আবার আত্মাসর্বস্বও নয়; দেহসর্বস্বও নয়; বরং সে দেহ ও আত্মা উভয়েরই সমন্বয়। এখানে দেহ আত্বার বাহন, আর আত্মা দেহরই পারিচালক।
প্রবৃত্তি ও বিবেক
সাধারণ অর্থে দেহের দাবিকে নাফস বা প্রবৃত্তি এবং আত্মাকে বিবেক বলে অভিহিত করা চলে। মানবদেহের ইন্দ্রিয়সূহকে বিভিন্ন বস্তুর প্রতি আকৃষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। এ আকর্ষণই প্রবৃত্তি। একদিকে দুনিয়ার আকর্ষণীয় বস্তুসমূহের প্রতি মানুষের তীব্রভাবে আকৃষ্ট হওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে, অপরদিকে তাকে সৎ ও অসৎ এবং ভালো ও মন্দ সম্বন্ধে সচেতন বিবেকশক্তি দান করা হয়েছে। এভাবে মানুষের মধ্যে প্রবৃত্তি ও বিবেকের বিপরীতমুখী তাড়না সৃষ্টি করা হয়েছে। মানুষ প্রবৃত্তির তাড়নায় যখনই বিবেকের বিপরীত কাজ করে তখনই বিবেক তাকে দংশন করতে থাকে। দেহ অসুস্থ হলে যেমন এর আকর্ষণীয় বস্তুর দিকে ধাবিত হয় না; তেমনি বিবেক অসুস্থ হলেও তার দংশন করার শক্তি হ্রাস পায়। স্বস্থ্যের নিয়ম পালন না করলে যেমন দেহ অসুস্থ হয়, তেমনি বিবেকের বিরুদ্ধে বারবার চললে বিবেকশক্তি লোপ পেতে থাকে। উ দু’টি শক্তির মধ্যে সমন্বয় সাধনের উপরই মানব জীবনের শান্তি সম্পূর্ণ নির্ভরশীল।
মানুষের উপযোগী শিক্ষা
মানুষকে যারা আত্মবিহীন এক জড় পদার্থ মনে করেন, তারা শিক্ষাব্যবস্থাকে তৈরি করার বেলায় মানুসের শুধু বস্তুগত প্রয়োজনের (Material need) দিকেই লক্ষ্য রাখেন। আর মানুষের প্রকৃত পরিচয় উপলব্ধি করতে অক্ষম হওয়ার ফলে সে ব্যবস্থায় মানুষকে অন্যান্য জীবের ন্যায়ই দেহসর্বস্ব মনে করে গড়ে তোলা হয়। পাশ্চাত্য সভ্যতা ধর্মনিরপেক্ষ ও খোদাবিমুখ বলে তার পক্ষে মানুষকে আত্মাপ্রধান হিসেবে চিনবার সযোগ হয়নি। ডারউইন মানুষকে বানরের উন্নত সংস্করণ প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। এ মতাদর্শের বিশ্বাসীরা মানুষকে অন্যান্য পশুর ন্যায় গড়ে তুলবার উপযোগী শিক্ষাপদ্ধতির প্রচরণ করেছেন। এ শিক্ষা দ্বারা মনুষ্যত্বের বিকাশ অসম্ভব।
আবার যারা মানুষকে আত্মসর্বস্ব মনে করেন অথবা তারা জৈবিক প্রয়োজনের দিকে মনোযোগ না দিয়ে কেবল আধ্যাত্মিক উন্নতির উদ্দেশ্যে শিক্ষার প্রচরণ করেন, তাঁরাও মানুষের উপযোগী প্রকৃত শিক্ষা দিতে অক্ষম। এ শিক্ষা মানুষকে যতই খোদাভীরু ও ধর্মপ্রাণ হওয়ার অনুপ্রেরণা দান করুক, বাস্তব জীবনে বস্তুগত প্রয়োজনের তাগিদ তাকে ঈমানের বিপরীত পথে যেতে বাধ্য করে। তাই এই প্রকার শিক্ষাও মানুষের স্বভাবের বিপরীত।
তাই যে শিক্ষা মানুষের আত্মা ও দেহকে এক সুন্দর সামঞ্জস্যময় পরিণতিতে পৌঁছিয়ে এ জগতের রূপ-রস-গন্ধকে নৈতিকতার সীমার মধ্যে উপভোগ করার যোগ্যতা দান করে, সেই শিক্ষাই মানুষের প্রকৃত শিক্ষা। যে শিক্ষা প্রাকৃতিক শক্তিসমূহকে মানবতার উন্নতি ও নৈতিকতার বিকাশে প্রয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ করে, তাই মানুষের উপযোগী শিক্ষা। আর জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উন্নতি দান করা সত্ত্বেও যে শিক্ষা মনুষ্যত্ব ও আত্মার উন্নতিকে ব্যাহত করে তা প্রকৃতপক্ষে মানব-ধ্বংসী শিক্ষা, তাকে কিছুতেই মানুষের উপযোগী শিক্ষা বলা চলে না।


শিক্ষাব্যবস্থায় জাতীয় আদর্শের স্থান
দুনিয়ার সকল শিক্ষাবিদই এ বিষয়ে একত যে, শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে চরিত্র গঠন। শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে মন, মস্কিষ্ট ও চরিত্রকে গঠন করার চেষ্টা প্রত্যেকটি সজাগ জাতির কার্যসূচিরত প্রদান অঙ্গ। উন্নত জাতিসমূহের শিক্ষাব্যবস্থায় বাহ্যিক দিক দিয়ে অনেক সামঞ্জস্য থাকলেও মূলত তাদের সকলেরিই একই ধরনে চরিত্র সৃষ্টি উদ্দেশ্য নয়। আমেরিকার শিক্ষাব্যবস্থায় যে প্রকার মন, মস্তিষ্ক ও চরিত্র সৃষ্টি হচ্ছে, রাশিয়ায় হুবহু তার অনুকরণ হচ্ছেনা। এর প্রকৃর কারণ হল তাদের আদর্শের পার্থক্য। ভালো-মন্দের পার্থক্যজ্ঞঅন, মূল্যবোধ, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা, ব্যক্তিচরিত্রের মান নির্ণয়, জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে কতক ধারণা ইত্যাদির সমন্বয়েই একটি আদর্শ গড়ে উঠে। যে জাতির নিকট যে আদর্শ গ্রহণযোগ্য, সেই আদর্শকে সম্মুখে রেখেই উক্ত জাতির শিক্ষাব্যবস্থাকে গড়ে তেলা হয়। প্রত্যেক দেশের কোন না কোন আদর্শ থাকে। সে আদর্শ নিজস্বও হতে পারে অথবা অপর কোন দেশের নিকট থেকে ধার করাও হতে পারে। কিন্তু কোন আদর্শ নির্ধরণ ব্যতীত কোন জাতিই উন্নতির পথে পদক্ষেপ করতে পারে না। আদর্শ একটি জাতির লক্ষ্য। যে জাতির কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই, সে অপরাপর জাতির উচ্চিষ্ঠভোগী হতে বাধ্য। একটি বিশেষ আদর্শে জাতিকে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যত প্রকার পরিকল্পনাই গ্রহণ করা হোক তা শেষ পর্যন্ত একই লক্ষ্যের দিকে দেশকে পরিচালিত করবে। সুতরাং শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের বেলায় জাতীয় আদর্শ নির্ধারণ অপরিহার্য।
আমাদের জাতীয় আদর্শ
আমাদের প্রিয় জন্মভূীম বাংলাদেশের জাতীয় আদর্শ কী এ বিষয়ে বিরাট মতপার্থক্য রয়েছে। এটাই এদেশের প্রধান সমস?্যা। এ কারণেই ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের গোলামী থেকে স্বাধীন হওয়ার পর গত ৫০ বছরেও দেশের সকল নাগেরিকের উযোগী কোন সমন্বিত শিক্ষা-ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। ১৯৪০-এর দশকে এ উপমহাদেশের স্বাধীনতা লাভের সযোগ আসে। মি. গান্ধি ও মি. হেরুর নেতৃত্বে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস ধর্ম-নিরপেক্ষতাবাদকে জাতীয় আদর্শ হিসেবে ঘোষণা করে। উপমহাদেশের ঐ সময়ের ১০ কোটি মুসলমানের পক্ষ থেকে কায়েদে আযম ‍মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে অল-ইন্ডিয়া মুলিম লীগ ইসলামকে জাতীয় আদর্শ ঘোষণা করে। ১৯৪৬ সালে এ ইস্যুকে কেন্ত্র করেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে মুসলমানদের শতকরা ৯৭টি ভোট ইসলামের পক্ষে পড়ে। ফলে আদর্শিক ভিত্তিতেহ ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে মুসলিম প্রদান অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান নামক একটি আদর্শিক রাষ্ট্র বিশ্বের মানচিত্রে স্থান লাভ করে।
দুর্ভাগ্যের বিষয় যে পাকিস্তানের শাসন-ক্ষমতা যাদের নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছিল তাঁদের মন-মগজ-চরিত্র ইংরেজ আমলের শিক্ষা-ব্যবস্থায়ই গড়ে উঠায় তাঁরা শিক্ষা-ব্যবস্থাকে ইসলামী আদর্শে ঢেলে সাজাবার কোন চেষ্টাই করেননি। তাঁরা ব্রিটিশ আমলের শিক্ষা-ব্যবস্থাকেই বহাল রাখেন। কিন্তু তাঁরা ব্রিটিশ আমলের শিক্ষার মানটুকুও বহাল রাখতে ব্যর্থ হন।
যে আদর্শের ভিত্তিতে পাকিস্তান কায়েম হয় সে আদর্শের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার ফলে শাসকরা গণতান্ত্রিক শাসন-ব্যবস্থাও চালু রাখা নিরাপদ মনে করেননি। অথচ জাগণের ভোটের মাধ্যমেই পাকিস্তানের জন্ম। গণতন্ত্র বহাল থাকলে জনগণ ইসলামী আদর্শের পক্ষেই ভোট দেমে মনে করেই আইয়ূব খান সামরিক স্বৈর-শাসন জারী করেন। ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে পাকিস্তান কায়েম হওয়া সত্বেও সে আদর্শের লালন না করায় আদর্শিক শূণ্যতা সৃষ্টি হয়ে গেল। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, সমাজকতন্ত্র ও বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ঐ শ্যন্যস্থান পূরণ করল। পরিণামে এদেশটি পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শাসকগণ ঐসব ইসলাম বিরোধী মতবাদকেই জাতীয় আদর্শ হিসেবে শাসনতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত করে নিলেন। ভারত থেকে আমদানী করা ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ ও রাশিয়া থেকে ধার করা সমাজতন্ত্র এদেশের মাটিতে শেকড় গড়াতে ব্যর্থ হয়। তাই গণভোটো মাধ্যমে ১৯৭৭ সালে জনগণ ঐ দুটো মতবাদকে বাতিল ঘোষণা করে। আর বাংলাদেশের নাগরিকদের পরিচয় বাংলাদেশেী হিসেবে ঘোষণা করার ফলে বাঙ্গালী জাতীতাবাদও মতবাদ হিসেবে পরিত্যক্ত হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামীল লীগ ক্ষমতাসীন হবার সযোগ পেয়ে দলীয়ভাবে এখনও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের বিশ্বাসী বলে দাবি করলেও এ দু্টো মতবাদ দেশের শাসনতন্ত্রে অনুপস্থিত। শাসনতন্ত্র দেশের যে আদর্শ ঘোষণা করেছে তা-ই জাতীয় আদর্শ। যারা সে আদর্শে বিশ্বাসী নয় তাদের ব্যাপারে জনগণই সিদ্ধান্ত নেবার অধিকারী। বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রে আদর্শ হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদরে বদলেসর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ লেখা হয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের আদর্শ ‘ইসলাম’ বলে দাবি করলে তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। ‍সুতরং আমাদের জাতীয় আদর্শ যে ইসলাম তা অনস্বীকার্য। যারা একথা অস্বীকার করতে চান তারা বলুন বাংলাদেশের আদর্শের নাম কী? বাংলাদেশের আদর্শ ইসলাম বলে স্বীকৃত না হলে পশ্চিম বঙ্গ থেকে আমাদের আলাদা থাকার কোন যুক্তি নেই। যারা এপার বাংলা ও ওপার বাংলাকে ঐক্যবদ্ধ করতে চান তাঁরা বাংলাদেশকে ভারতের একটি প্রদেশে পরিণত করতে আগ্রহী। তাই একমাত্র ইসলামী আদর্শের ধারক হিসেবে বেঁচে থাকতে চাইলেই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রয়োজন। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে বাংলাদশের আদর্শ বলে নিলে ১৯৪৭ সালে ভারত থেকে আলাদা হওয়া কোন যুক্তি থাকে না।

No comments

শিক্ষাব্যবস্থার ইসলামী রূপরেখা...(2) Overview of Islamic education





কুরআনে মানুষের পরিচয়
কুরআন অন্যান্য জীবের সাথে মানুষের যে ব্যবধা নির্দেশ করে তা এই যে, ‘মানুষ নৈতিক জীব’ আর অন্যান্য জীব নৈতিকতার বন্ধন থেকে সম্পূর্ণ ‍মুক্ত। ভালো ও মন্দ, সৎ ও অসৎ, সত্য ও মিথ্যার বিচার করার ক্ষমতা মানুষ ছাড়া আর কোন জীবের মধ্যে আমরা দেখতে পাই না। মিথ্যার বেসাতিই যার সম্বল, সে মানুষটিও ‘মিথ্যা বলা অন্যায়’ বলে স্বীকার করে। মিথ্যা বলাকে ভালো কাজ মনে করলে সে ‘মিথ্যুক’ উপাধিতে ভূষিত হওয়া পছন্দ করতো। ‘চুরি করা খারাপ’ এ কথা স্বীকার করে বলেই চোর প্রকাশ্যে না গিযে গোপনে চুরি করতে যায়। ভালোমন্দের এই বিচারজ্ঞানই মানুষকে অন্যান্য জীব থেকে পৃথক করেছে। যারা এঈ নৈতিক দিককে উন্নতি করার চেষ্টা করে না, কুরআন তাদের সম্বন্ধে মন্তব্য করে যে, “তারা পশুর ন্যায়; বরং পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট।” নৈতিকতার উন্নতি ব্যতীত মানুষ তার যাবতীয় শক্তি যখন ব্যবহার করে তখন সে পশুর চেয়েও অনিষ্টকর ও ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। চিন্তাশক্তিও বুদ্দি মানুষের বিরাট অস্ত্র। এ অস্ত্রের সাহায্যে শারীরিক আকারে ক্ষুদ্র হয়েও সে বিরাট বপুবিশিষ্ট হাতীর উপর কর্তৃত্ব করে। কিন্তু নৈতিকতার বিকাশ না হলে এই বুদ্ধিশক্তিকেই সে মানব জাতির অকল্যাণে প্রয়োগ করে। কিন্তু নৈতিকতার অবনতির ফলে যখন কেউ মিথ্যা বলে তখন সে কুকুরের চেয়েও অধম হয়ে পড়ে। কেননা কুকুর মিথ্যা বলতে পারে না। তাই বস্তুগত শক্তির সঠিক ব্যবহার নৈতিকতার উপরই নির্ভরশীল। একটি ছুরি নৈতিকতা সম্পন্ন ব্যক্তির হাতে ব্যবহৃত হলে তা মানুষের উপকারই করবে। কিন্তু নৈতিকতার অভাব হলে এ ছুরিই তাকে ডাকাতে পরিণত করবে। নৈতিকতার বিকাশ ব্যতী আধুনিক বিশ্ব এতো প্রচণ্ড বস্তুরশক্তির অধিকারী হয়েছে, বলেই আজ মানব জাতি এতো বড় সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। আণবিক শক্তি ও মহাশূন্যের ব্যবহার আজ মানব জাতির অস্তিত্বকে শঙ্কুল করে তুলেছে। কেননা এসব শক্তি নৈতিকতায় ভূষিত মানবের হাতে ব্যবহৃত হচ্ছে না, নৈতিকতাহীন দানবের হিংস্র থাবা দ্বারাই এদের ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।
কুরআন হাত. পা, চোখ-কানবিশিষ্ট শরীরটিকে প্রকৃত মানুষ মনে করে না। কুরআনের মতে, এ দেহ সৃষ্টির বহু পূর্বে মানুষ সৃষ্টি হয়েছে। কুরআনের পরিভাষায় সেই মানুষটিই হলো ‘রূহ’ বা আত্মা। এ আত্মাই নৈতিকতার আধার। রূহকে উন্নত করার ব্যবস্থা না করলে এ শরীর পশুর ন্যায় ব্যবহার করবে। শরীরের যত সব বস্তুগত দাবি আছে তা পূরণের জন্য মানবদেহ সকল সময়ই ব্যস্ত। পেট খালি হলেই সে খাদ্যের জন্য ব্যস্ত হয়। মানুষ সেই খাদ্য চুরি করে আনলো, না পরিশ্রম করে অর্জন করলো সে বিষয়ে পেটের কোন মাথাব্যাথা নেই। তার খাদ্যের প্রয়োজন। অন্যায়ভাবে খাদ্য এনে দিলেও সে নিশ্চিন্তে খেতে থাকে। কিন্তু তখন রূহ বলতে থাকে যে, কাজটা অন্যায় হলো। গৃহপালিত পশু রজ্জু ছিঁড়ে নিজেরই দয়ালু মনিবের সাজানো বাগান খেতে একটুও দ্বিধাবোধ করে না। নৈতিকতার বন্ধন ছিঁড়তে পারলে মানবদেহও তেমনি একটি পশুতে পরিণত হয়। মহানবী (স) তাই নৈতিকিতাসম্পন্ন মানুষকে এমন এক ঘোড়ার সাথে তুলনা করেছেন, যা রজ্জু দ্বারা এক খুঁটির সাথে আবদ্ধ। এ ঘোড়াটি যেমন স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে পারে না তেমনি মানুষ স্বাধীনতাও নৈতিকতার রজ্জু দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাই কেবল রজ্জুর সীমা পর্যন্তই সে স্বাধীনভবে চলাফেরা করতে সক্ষম।
দেহ ও আত্মার দ্বন্দ্ব
উপরিউক্ত আলোচনা ছাড়াও প্রত্যেক ব্যক্তিই তার বাস্তব অভিজ্ঞতা হতে এ কথা স্বীকার করতে বাধ্য যে, মানুষের আত্মার সাথে তার দেহের এক চিরন্তন দ্বন্দ্ব লেগে আছে। মানুষ অনেক নৈতিকতা বিরোধী কার্যকলাপ হতে বেঁচে থাকতে চেষ্টা করে কিন্তু অনেক সময় দেহের তাগিদের নিকট পরাজয় বরণ করে। এ দ্বন্দ্বে দেহের জ্বালায় অস্থির হয়েই একশ্রেণীর মানুষ নৈতিকতার চাপে বৈরাগী হওয়ার প্রেরণা লাভ করে। তারা ‘দরবেশ’ ও ‘সন্যাসী’ হলেও মানুষের মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হয়। তারা নির্জীব পাথর ও নিশ্চল গাছের ন্যায় জীবন-যাপন করে মনুষ্যত্বের উচ্চস্থান থেকে পতিত হয়। আবার অন্যদিকে অধিকাংশ লোক দেহের নিকট পরাজিত হয়ে আত্মাকে পঙ্গু করে পশুর ন্যায় জীবনযাপন করে। কুরআনে মানুষকে এ দ্বন্দ্বে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য যে বিধান দিয়েছে, তা দেহের সকল দাবিকে নৈতিকতার সীমার ভেতরে পূরণ করতে সাহায্য করে। দেহের দাবিকে অস্বীকার করার বিরুদ্ধে কুরআন বলে, “বৈরাগ্য সাধনের নীতি মানুষ নিজেই আবিষ্কার করেছে, আমরা তাকে এ নির্দেশ দান করিনি।” (সূরা হাদীদ: ২৭)
আত্মা ও দেহের দ্বন্দ্বে দেহকে অস্বীকার করার বৈরাগ্য নীতি যেমন মানুষের উপযোগী নয়, তেমনি আত্মাকে পরাজিত করে পশুর ন্যায় ভোগবাদ ও ভোগবাদের মাঝামাঝি মনুষ্যত্বের সিরাতুল মুস্তাকীমই কুরআনের শেখানো পথ। তাই কুরআনর মতে মানুষ আত্মাহীনও নয়, দেহহীনও নয়; আবার আত্মাসর্বস্বও নয়; দেহসর্বস্বও নয়; বরং সে দেহ ও আত্মা উভয়েরই সমন্বয়। এখানে দেহ আত্বার বাহন, আর আত্মা দেহরই পারিচালক।
প্রবৃত্তি ও বিবেক
সাধারণ অর্থে দেহের দাবিকে নাফস বা প্রবৃত্তি এবং আত্মাকে বিবেক বলে অভিহিত করা চলে। মানবদেহের ইন্দ্রিয়সূহকে বিভিন্ন বস্তুর প্রতি আকৃষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। এ আকর্ষণই প্রবৃত্তি। একদিকে দুনিয়ার আকর্ষণীয় বস্তুসমূহের প্রতি মানুষের তীব্রভাবে আকৃষ্ট হওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে, অপরদিকে তাকে সৎ ও অসৎ এবং ভালো ও মন্দ সম্বন্ধে সচেতন বিবেকশক্তি দান করা হয়েছে। এভাবে মানুষের মধ্যে প্রবৃত্তি ও বিবেকের বিপরীতমুখী তাড়না সৃষ্টি করা হয়েছে। মানুষ প্রবৃত্তির তাড়নায় যখনই বিবেকের বিপরীত কাজ করে তখনই বিবেক তাকে দংশন করতে থাকে। দেহ অসুস্থ হলে যেমন এর আকর্ষণীয় বস্তুর দিকে ধাবিত হয় না; তেমনি বিবেক অসুস্থ হলেও তার দংশন করার শক্তি হ্রাস পায়। স্বস্থ্যের নিয়ম পালন না করলে যেমন দেহ অসুস্থ হয়, তেমনি বিবেকের বিরুদ্ধে বারবার চললে বিবেকশক্তি লোপ পেতে থাকে। উ দু’টি শক্তির মধ্যে সমন্বয় সাধনের উপরই মানব জীবনের শান্তি সম্পূর্ণ নির্ভরশীল।
মানুষের উপযোগী শিক্ষা
মানুষকে যারা আত্মবিহীন এক জড় পদার্থ মনে করেন, তারা শিক্ষাব্যবস্থাকে তৈরি করার বেলায় মানুসের শুধু বস্তুগত প্রয়োজনের (Material need) দিকেই লক্ষ্য রাখেন। আর মানুষের প্রকৃত পরিচয় উপলব্ধি করতে অক্ষম হওয়ার ফলে সে ব্যবস্থায় মানুষকে অন্যান্য জীবের ন্যায়ই দেহসর্বস্ব মনে করে গড়ে তোলা হয়। পাশ্চাত্য সভ্যতা ধর্মনিরপেক্ষ ও খোদাবিমুখ বলে তার পক্ষে মানুষকে আত্মাপ্রধান হিসেবে চিনবার সযোগ হয়নি। ডারউইন মানুষকে বানরের উন্নত সংস্করণ প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। এ মতাদর্শের বিশ্বাসীরা মানুষকে অন্যান্য পশুর ন্যায় গড়ে তুলবার উপযোগী শিক্ষাপদ্ধতির প্রচরণ করেছেন। এ শিক্ষা দ্বারা মনুষ্যত্বের বিকাশ অসম্ভব।
আবার যারা মানুষকে আত্মসর্বস্ব মনে করেন অথবা তারা জৈবিক প্রয়োজনের দিকে মনোযোগ না দিয়ে কেবল আধ্যাত্মিক উন্নতির উদ্দেশ্যে শিক্ষার প্রচরণ করেন, তাঁরাও মানুষের উপযোগী প্রকৃত শিক্ষা দিতে অক্ষম। এ শিক্ষা মানুষকে যতই খোদাভীরু ও ধর্মপ্রাণ হওয়ার অনুপ্রেরণা দান করুক, বাস্তব জীবনে বস্তুগত প্রয়োজনের তাগিদ তাকে ঈমানের বিপরীত পথে যেতে বাধ্য করে। তাই এই প্রকার শিক্ষাও মানুষের স্বভাবের বিপরীত।
তাই যে শিক্ষা মানুষের আত্মা ও দেহকে এক সুন্দর সামঞ্জস্যময় পরিণতিতে পৌঁছিয়ে এ জগতের রূপ-রস-গন্ধকে নৈতিকতার সীমার মধ্যে উপভোগ করার যোগ্যতা দান করে, সেই শিক্ষাই মানুষের প্রকৃত শিক্ষা। যে শিক্ষা প্রাকৃতিক শক্তিসমূহকে মানবতার উন্নতি ও নৈতিকতার বিকাশে প্রয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ করে, তাই মানুষের উপযোগী শিক্ষা। আর জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উন্নতি দান করা সত্ত্বেও যে শিক্ষা মনুষ্যত্ব ও আত্মার উন্নতিকে ব্যাহত করে তা প্রকৃতপক্ষে মানব-ধ্বংসী শিক্ষা, তাকে কিছুতেই মানুষের উপযোগী শিক্ষা বলা চলে না।


শিক্ষাব্যবস্থায় জাতীয় আদর্শের স্থান
দুনিয়ার সকল শিক্ষাবিদই এ বিষয়ে একত যে, শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে চরিত্র গঠন। শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে মন, মস্কিষ্ট ও চরিত্রকে গঠন করার চেষ্টা প্রত্যেকটি সজাগ জাতির কার্যসূচিরত প্রদান অঙ্গ। উন্নত জাতিসমূহের শিক্ষাব্যবস্থায় বাহ্যিক দিক দিয়ে অনেক সামঞ্জস্য থাকলেও মূলত তাদের সকলেরিই একই ধরনে চরিত্র সৃষ্টি উদ্দেশ্য নয়। আমেরিকার শিক্ষাব্যবস্থায় যে প্রকার মন, মস্তিষ্ক ও চরিত্র সৃষ্টি হচ্ছে, রাশিয়ায় হুবহু তার অনুকরণ হচ্ছেনা। এর প্রকৃর কারণ হল তাদের আদর্শের পার্থক্য। ভালো-মন্দের পার্থক্যজ্ঞঅন, মূল্যবোধ, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা, ব্যক্তিচরিত্রের মান নির্ণয়, জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে কতক ধারণা ইত্যাদির সমন্বয়েই একটি আদর্শ গড়ে উঠে। যে জাতির নিকট যে আদর্শ গ্রহণযোগ্য, সেই আদর্শকে সম্মুখে রেখেই উক্ত জাতির শিক্ষাব্যবস্থাকে গড়ে তেলা হয়। প্রত্যেক দেশের কোন না কোন আদর্শ থাকে। সে আদর্শ নিজস্বও হতে পারে অথবা অপর কোন দেশের নিকট থেকে ধার করাও হতে পারে। কিন্তু কোন আদর্শ নির্ধরণ ব্যতীত কোন জাতিই উন্নতির পথে পদক্ষেপ করতে পারে না। আদর্শ একটি জাতির লক্ষ্য। যে জাতির কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই, সে অপরাপর জাতির উচ্চিষ্ঠভোগী হতে বাধ্য। একটি বিশেষ আদর্শে জাতিকে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যত প্রকার পরিকল্পনাই গ্রহণ করা হোক তা শেষ পর্যন্ত একই লক্ষ্যের দিকে দেশকে পরিচালিত করবে। সুতরাং শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের বেলায় জাতীয় আদর্শ নির্ধারণ অপরিহার্য।
আমাদের জাতীয় আদর্শ
আমাদের প্রিয় জন্মভূীম বাংলাদেশের জাতীয় আদর্শ কী এ বিষয়ে বিরাট মতপার্থক্য রয়েছে। এটাই এদেশের প্রধান সমস?্যা। এ কারণেই ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের গোলামী থেকে স্বাধীন হওয়ার পর গত ৫০ বছরেও দেশের সকল নাগেরিকের উযোগী কোন সমন্বিত শিক্ষা-ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। ১৯৪০-এর দশকে এ উপমহাদেশের স্বাধীনতা লাভের সযোগ আসে। মি. গান্ধি ও মি. হেরুর নেতৃত্বে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস ধর্ম-নিরপেক্ষতাবাদকে জাতীয় আদর্শ হিসেবে ঘোষণা করে। উপমহাদেশের ঐ সময়ের ১০ কোটি মুসলমানের পক্ষ থেকে কায়েদে আযম ‍মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে অল-ইন্ডিয়া মুলিম লীগ ইসলামকে জাতীয় আদর্শ ঘোষণা করে। ১৯৪৬ সালে এ ইস্যুকে কেন্ত্র করেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে মুসলমানদের শতকরা ৯৭টি ভোট ইসলামের পক্ষে পড়ে। ফলে আদর্শিক ভিত্তিতেহ ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে মুসলিম প্রদান অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান নামক একটি আদর্শিক রাষ্ট্র বিশ্বের মানচিত্রে স্থান লাভ করে।
দুর্ভাগ্যের বিষয় যে পাকিস্তানের শাসন-ক্ষমতা যাদের নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছিল তাঁদের মন-মগজ-চরিত্র ইংরেজ আমলের শিক্ষা-ব্যবস্থায়ই গড়ে উঠায় তাঁরা শিক্ষা-ব্যবস্থাকে ইসলামী আদর্শে ঢেলে সাজাবার কোন চেষ্টাই করেননি। তাঁরা ব্রিটিশ আমলের শিক্ষা-ব্যবস্থাকেই বহাল রাখেন। কিন্তু তাঁরা ব্রিটিশ আমলের শিক্ষার মানটুকুও বহাল রাখতে ব্যর্থ হন।
যে আদর্শের ভিত্তিতে পাকিস্তান কায়েম হয় সে আদর্শের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার ফলে শাসকরা গণতান্ত্রিক শাসন-ব্যবস্থাও চালু রাখা নিরাপদ মনে করেননি। অথচ জাগণের ভোটের মাধ্যমেই পাকিস্তানের জন্ম। গণতন্ত্র বহাল থাকলে জনগণ ইসলামী আদর্শের পক্ষেই ভোট দেমে মনে করেই আইয়ূব খান সামরিক স্বৈর-শাসন জারী করেন। ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে পাকিস্তান কায়েম হওয়া সত্বেও সে আদর্শের লালন না করায় আদর্শিক শূণ্যতা সৃষ্টি হয়ে গেল। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, সমাজকতন্ত্র ও বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ঐ শ্যন্যস্থান পূরণ করল। পরিণামে এদেশটি পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শাসকগণ ঐসব ইসলাম বিরোধী মতবাদকেই জাতীয় আদর্শ হিসেবে শাসনতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত করে নিলেন। ভারত থেকে আমদানী করা ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ ও রাশিয়া থেকে ধার করা সমাজতন্ত্র এদেশের মাটিতে শেকড় গড়াতে ব্যর্থ হয়। তাই গণভোটো মাধ্যমে ১৯৭৭ সালে জনগণ ঐ দুটো মতবাদকে বাতিল ঘোষণা করে। আর বাংলাদেশের নাগরিকদের পরিচয় বাংলাদেশেী হিসেবে ঘোষণা করার ফলে বাঙ্গালী জাতীতাবাদও মতবাদ হিসেবে পরিত্যক্ত হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামীল লীগ ক্ষমতাসীন হবার সযোগ পেয়ে দলীয়ভাবে এখনও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের বিশ্বাসী বলে দাবি করলেও এ দু্টো মতবাদ দেশের শাসনতন্ত্রে অনুপস্থিত। শাসনতন্ত্র দেশের যে আদর্শ ঘোষণা করেছে তা-ই জাতীয় আদর্শ। যারা সে আদর্শে বিশ্বাসী নয় তাদের ব্যাপারে জনগণই সিদ্ধান্ত নেবার অধিকারী। বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রে আদর্শ হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদরে বদলেসর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ লেখা হয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের আদর্শ ‘ইসলাম’ বলে দাবি করলে তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। ‍সুতরং আমাদের জাতীয় আদর্শ যে ইসলাম তা অনস্বীকার্য। যারা একথা অস্বীকার করতে চান তারা বলুন বাংলাদেশের আদর্শের নাম কী? বাংলাদেশের আদর্শ ইসলাম বলে স্বীকৃত না হলে পশ্চিম বঙ্গ থেকে আমাদের আলাদা থাকার কোন যুক্তি নেই। যারা এপার বাংলা ও ওপার বাংলাকে ঐক্যবদ্ধ করতে চান তাঁরা বাংলাদেশকে ভারতের একটি প্রদেশে পরিণত করতে আগ্রহী। তাই একমাত্র ইসলামী আদর্শের ধারক হিসেবে বেঁচে থাকতে চাইলেই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রয়োজন। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে বাংলাদশের আদর্শ বলে নিলে ১৯৪৭ সালে ভারত থেকে আলাদা হওয়া কোন যুক্তি থাকে না।

No comments