Breaking News

১৬ আগস্টের মধ্যে পোশাকশ্রমিকদের বোনাস দেয়ার নির্দেশ

মারাকানাজো: দু’লক্ষ মানুষ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো যেদিন

মারাকানাজো: দু’লক্ষ মানুষ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো যেদিন


প্রায় ২ লক্ষ মানুষে ঠাসা ব্রাজিলের মারাকানা স্টেডিয়াম। অথচ পিনপতন নীরবতা। একটু চেষ্টা করলে নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দও শোনা যাবে, ১৯৫০ সালের জুলাইয়ের ১৬ তারিখে এরকম অদ্ভুত নীরবতার সাক্ষী ছিলো মারাকানা স্টেডিয়াম। দু’লক্ষ মানুষকে স্তব্ধ বানিয়ে দেওয়া আলসিডেস ঘিগিয়া ব্যাপারটি নিজেই ব্যাখ্যা করেছিলেন। তিনি বলেছেন, “পুরো মারাকানাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিলেন তিনজন। ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা, পোপ এবং আমি।” বলছিলাম বিখ্যাত মারাকানাজোর কথা, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় মারাকানা বিপর্যয়।


১৯৫০ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ পায় সাম্বাখ্যাত ল্যাটিন ফুটবল পরাশক্তি ব্রাজিল। ১৬ দল নিয়ে আয়োজিত হয় বিশ্বকাপটি। কিন্তু বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার আগে ফ্রান্স, আর্জেন্টিনা ও ভারত টুর্নামেন্ট থেকে সরে দাঁড়ালে ১৩টি দল নিয়েই শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী প্রথম বিশ্বকাপ। প্রতি গ্রুপে চারটি করে দল থাকলেও দুই টিম সরে দাঁড়ানোয় ডি গ্রুপে থাকা উরুগুয়েকে মাত্র একটি ম্যাচ খেলতে হয়। বলিভিয়াকে ৮-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে প্রথম দল হিসেবে নক আউট পর্বে পৌঁছায় ওব্দোলিও ভারেলার উরুগুয়ে। অন্যদিকে বাকি তিন গ্রুপ থেকে তিন চ্যাম্পিয়ন হিসেবে নক আউট স্টেজে উরুগুয়ের সাথে যোগদান করে স্বাগতিক ব্রাজিল, সুইডেন এবং স্পেন। তবে সেবার রবিন রাউন্ড সিস্টেমে কোনো ফাইনাল ছিলো না। সবাই সবার মুখোমুখি হওয়ার পর সর্বোচ্চ পয়েন্ট পাওয়া দলকে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হবে। ফেভারিট তকমা সেটে থাকার প্রতিদান দেয় ব্রাজিল প্রথম দুই ম্যাচেই।

প্রথম ম্যাচে সুইডেনকে ৭-১ এবং দ্বিতীয় ম্যাচে স্পেনকে ৬-১ গোলে উড়িয়ে দেয় সেলেকাওরা। চার পয়েন্ট নিয়ে পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে চলে আসে ব্রাজিল।অন্যদিকে উরুগুয়ে মোটামুটি ভাগ্যের জোরেই দুই ম্যাচ থেকে পয়েন্ট আদায় করে নেয়। প্রথম ম্যাচে স্পেনের সাথে ২-১ গোলে পিছিয়ে যাওয়ার পর ২-২ গোলে ড্র করতে সক্ষম হয় তারা। দ্বিতীয় ম্যাচে তারা সুইডেনকে ন্যূনতম ব্যবধান ৩-২ গোলে হারায়। জয়সূচক গোলটি এসেছিলো ম্যাচ শেষ হওয়ার পাঁচ মিনিট আগে। দুই রাউন্ড শেষে তিন পয়েন্ট নিয়ে উরুগুয়ে চলে আসে টেবিলের দ্বিতীয় অবস্থানে। সে হিসেবে শেষ রাউন্ডের ব্রাজিল বনাম উরুগুয়ে ম্যাচটি অলিখিত ফাইনালে রূপ নেয়। শিরোপা জয়ের জন্য উরুগুয়ের ব্রাজিলকে হারানো ছাড়া কোনো বিকল্প ছিলো না। অন্যদিকে শুধুমাত্র হার এড়ালেই প্রথমবারের মতো ঘরের মাঠের দর্শকের সামনে জুলে রিমে ট্রফি উঁচিয়ে ধরতে পারতো ব্রাজিল।


ফাইনাল ম্যাচের আগে আগেই সংবাদমাধ্যমগুলো ব্রাজিলকে অগ্রিম চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করে বড় বড় শিরোনাম করে ফেলে। ২২টি গোল্ড মেডেলও ব্রাজিলের খেলোয়াড়দের নাম খোদাই করা হয়ে গিয়েছিলো ম্যাচ শুরুর আগে। ফাইনাল শুরু হওয়ার দু’ঘণ্টা আগে দেওয়া বক্তব্যে রিও ডি জেনেইরোর মেয়র পর্যন্ত ‘চ্যাম্পিয়ন’ সম্বোধন করেন ব্রাজিলের ফুটবল টিমকে। ‘Brasil os Vencedores’ নামে একটি গান রচনা করা হয় ম্যাচ শেষে গাওয়ার জন্য। অবশ্য পুরো ব্যাপারটি অযৌক্তিক কিছু ছিলো না।প্রথমত, রবিন রাউন্ডের দুই ম্যাচেই দুই দলের শক্তির বিস্তর ফারাকের ব্যাপারটা বোঝা গিয়েছিলো। যেখানে ব্রাজিল প্রতিপক্ষকে স্রেফ উড়িয়ে দিয়েছে, সেখানে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে জিতেছিলো ব্রাজিলের প্রতিবেশী দেশ উরুগুয়ে।

দ্বিতীয়ত, আগের বছরেই ব্রাজিলের মাঠে অনুষ্ঠিত হওয়া কোপা আমেরিকা চ্যাম্পিয়নও ছিলো ব্রাজিল। শুধু চ্যাম্পিয়ন বললে ভুল হবে, রীতিমতো শাসন করেছে প্রতিটি দলকেই। সেই টুর্নামেন্টে ৮ ম্যাচে ৪৬ গোল করেছিলো সেলেকাওরা। ফাইনালে প্যারাগুয়েকে হারিয়েছিলো ৭-০ গোলে। বলা বাহুল্য, উরুগুয়েকেও তারা গ্রুপ পর্বের ম্যাচে ৫-১ গোলে হারিয়েছিলো। আক্রমণাত্মক মনোভাব নিয়ে খেলতে নামা ব্রাজিলের সাথে উরুগুয়ে কত গোল হজম করে, সেটাই ছিলো ফাইনালের আগে মুখ্য বিষয়।


ফাইনাল ম্যাচের আগের দিন ব্রাজিলের তৎকালীন বিখ্যাত দৈনিক ও মুন্ডো ব্রাজিল টিমের ছবি দিয়ে শিরোনাম করেছিলো ‘These are the Champions!’। উরুগুয়ে অধিনায়ক ওব্দুলিও ভারেলা যতগুলো কপি পারা যায়, সব কিনে আনেন। তারপর সেগুলো নিজেদের বাথরুমের ফ্লোরে বিছিয়ে সতীর্থদের সেগুলোর উপর মূত্র বিসর্জন করতে উৎসাহিত করেন।

ম্যাচের আগে ট্যাকটিস হিসেবে উরুগুইয়ান কোচ জুয়ান লোপেজ ডিফেন্সিভ খেলার জন্য দিক নির্দেশনা দেন। কোচ চলে যাওয়ার পর ভারেলা উঠে দাঁড়ান। দলের উদ্দেশে তিনি বলেন যে, জুয়ান লোপেজ একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। তবে আজ তার কথা শুনলে আমাদের অবস্থাও হবে স্পেন, সুইডেনের মতো। তারপর নিজেদের খেলোয়াড়দের প্রতি তিনি একটি আবেগময় বক্তব্যও রাখেন। এই বক্তব্যটিই তাঁতিয়ে দেয় উরুগুইয়ানদের।


১৯৫০ সাল, ১৬ জুলাই। রিও ডি জেনেইরোর রাস্তায় সাজ সাজ রব। সাম্বা নাচে তখন উত্তাল পুরো ব্রাজিল। তৎকালীন সবচেয়ে বড় স্টেডিয়াম মারাকানাতে ভিড় জমাতে শুরু করে মানুষ। ২ লক্ষ ধারণ ক্ষমতার স্টেডিয়ামটিতে উপস্থিত হয় ১,৯৯,৮৫৪ জন মানুষ। সবাই ব্রাজিলের জয়োৎসবে যোগদান করার নিমিত্তেই আসে বিখ্যাত এই স্টেডিয়ামটিতে।ম্যাচ শুরুর হুইসেলের পর চিরাচরিত আক্রমণাত্মক ব্রাজিলকেই দেখা যায়। পুরো প্রথম হাফ জুড়ে উরুগুয়েকে ব্রাজিলের আক্রমণ আটকাতেই ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। তবুও স্পেন আর সুইডেনের মতো অবস্থা হয়নি উরুগুয়ের। কোনো গোল না খেয়েই প্রথমার্ধ শেষ করতে সক্ষম হয় দলটি। তবে দ্বিতীয়ার্ধে এসে দুই মিনিটের মাথায় গোল পেয়ে যায় সেলেকাওরা। সাও পাওলো স্ট্রাইকার ফ্রিয়াকার গোলে এগিয়ে যায় ব্রাজিল। গোল খাওয়ার পরও দমে যাননি উরুগুয়ে অধিনায়ক ভারেলা। বল নিয়ে সেন্টারে গিয়ে নিজেদের খেলোয়াড়দের উদ্দেশে চিৎকার করে বলেন, “এখনই সময় জেতার।” অধিনায়কের কথায় জেগে উঠে উরুগুয়ে। হঠাৎ করে পাল্টা আক্রমণাত্মক খেলা শুরু করে উরুগুয়ে। পুরো টুর্নামেন্টে এরকম আক্রমণ আটকাতে হয়নি ব্রাজিল ডিফেন্সকে। হঠাৎ করে আসা উরুগুইয়ান অ্যাটাকে মোটামুটি হকচকিয়েই যায় ব্রাজিল ডিফেন্স। হকচকিয়ে যাওয়া ডিফেন্সকে হতভম্ব করে ৬৬ মিনিটে গোল করে উরুগুয়েকে সমতায় ফেরান জুয়ান আলবার্তো শিফিয়ানো। তবে পুরো স্টেডিয়াম আর ব্রাজিলকে চূড়ান্তভাবে স্তব্ধ করেন আলসিডেস ঘিগিয়া। ম্যাচ শেষ হওয়ার ১১ মিনিট আগে ব্রাজিলের জালে বল জড়ান তিনি। তার এই মহামূল্যবান গোলটির পাস এসেছিলো উরুগুয়ের ‘এল কাপিতানো’ খ্যাত ভারেলার পা থেকে। ব্রাজিল গোলকিপার বারবোসার পায়ের নিচ দিয়ে নেওয়া লো শটে তিনি এনে দেন উরুগুয়ের বহু আরাধ্য গোলটি। পুরা স্টেডিয়াম নিশ্চুপ হয়ে যায় ঘিগিয়ার গোলের পর। যেটিকে পরবর্তীতে ঘিগিয়া বলেছিলেন ‘The sound of silence’। এরপরের শত চেষ্টাতেও গোলের দেখা পায়নি ব্রাজিল। ইংলিশ রেফারি জর্জ রিডারের শেষ হুইসেলে উরুগুয়ে জিতে নেয় নিজেদের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ ট্রফি। ভারেলা এবং ঘিগিয়া বনে যান উরুগুয়ের জাতীয় বীর।







“ব্রাজিলে যেকোনো অন্যায়ের সর্বোচ্চ শাস্তি ৩০ বছর। কিন্তু ৪৪ বছর হয়ে গেলো আমি এখনো শাস্তি ভোগ করে যাচ্ছি, যদিও আমি কোনো অন্যায় করিনি।”

সেই বিশ্বকাপের ৪৪ বছর পর আক্ষেপ নিয়ে বলছিলেন ফাইনালের ব্রাজিলিয়ান গোলরক্ষক বারবোসা। ফাইনালের পর থেকে একরকম নিঃগৃহীতই ছিলেন তিনি। ফাইনালে পরা সাদা জার্সিটিও অভিশপ্ত জার্সি হিসেবে আখ্যা পায়। জনগণের দাবিতে বাধ্য হয়ে ব্রাজিলিয়ান ফুটবল ফেডারেশন চিরতরে জার্সিটির রং পরিবর্তন করে ফেলে।

১৯৫০ সালে সেই ফাইনালের সময় পেলের বয়স ছিলো মাত্র নয়। পরবর্তীতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পেলে বলেছিলেন, তিনি তার বাবাকে একদিন কাঁদতে দেখেন। কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে তার বাবা বলেছিলেন, “আমরা বিশ্বকাপ ফাইনাল হেরে গেছি।” পেলে উত্তর দিয়েছিলেন, “কেঁদো না বাবা, আমি ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ এনে দেবো।” আট বছর পর ১৭ বছর বয়সী পেলে ব্রাজিলকে এনে দেন প্রথম বিশ্বকাপ। পরবর্তীতে জেতান আরো দুটি। পাঁচটি বিশ্বকাপ নিয়ে ব্রাজিল বর্তমানে বিশ্বকাপের সবচেয়ে সফল দল। তবুও বিশ্বকাপের নামে ব্রাজিলে একটি হাহাকার কান পাতলেই শোনা যায়। মারাকানাজো!

 ::::----:::ফেসবুক থেকে সংগৃহীত::::----

No comments

মারাকানাজো: দু’লক্ষ মানুষ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো যেদিন

মারাকানাজো: দু’লক্ষ মানুষ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো যেদিন


প্রায় ২ লক্ষ মানুষে ঠাসা ব্রাজিলের মারাকানা স্টেডিয়াম। অথচ পিনপতন নীরবতা। একটু চেষ্টা করলে নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দও শোনা যাবে, ১৯৫০ সালের জুলাইয়ের ১৬ তারিখে এরকম অদ্ভুত নীরবতার সাক্ষী ছিলো মারাকানা স্টেডিয়াম। দু’লক্ষ মানুষকে স্তব্ধ বানিয়ে দেওয়া আলসিডেস ঘিগিয়া ব্যাপারটি নিজেই ব্যাখ্যা করেছিলেন। তিনি বলেছেন, “পুরো মারাকানাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিলেন তিনজন। ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা, পোপ এবং আমি।” বলছিলাম বিখ্যাত মারাকানাজোর কথা, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় মারাকানা বিপর্যয়।


১৯৫০ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ পায় সাম্বাখ্যাত ল্যাটিন ফুটবল পরাশক্তি ব্রাজিল। ১৬ দল নিয়ে আয়োজিত হয় বিশ্বকাপটি। কিন্তু বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার আগে ফ্রান্স, আর্জেন্টিনা ও ভারত টুর্নামেন্ট থেকে সরে দাঁড়ালে ১৩টি দল নিয়েই শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী প্রথম বিশ্বকাপ। প্রতি গ্রুপে চারটি করে দল থাকলেও দুই টিম সরে দাঁড়ানোয় ডি গ্রুপে থাকা উরুগুয়েকে মাত্র একটি ম্যাচ খেলতে হয়। বলিভিয়াকে ৮-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে প্রথম দল হিসেবে নক আউট পর্বে পৌঁছায় ওব্দোলিও ভারেলার উরুগুয়ে। অন্যদিকে বাকি তিন গ্রুপ থেকে তিন চ্যাম্পিয়ন হিসেবে নক আউট স্টেজে উরুগুয়ের সাথে যোগদান করে স্বাগতিক ব্রাজিল, সুইডেন এবং স্পেন। তবে সেবার রবিন রাউন্ড সিস্টেমে কোনো ফাইনাল ছিলো না। সবাই সবার মুখোমুখি হওয়ার পর সর্বোচ্চ পয়েন্ট পাওয়া দলকে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হবে। ফেভারিট তকমা সেটে থাকার প্রতিদান দেয় ব্রাজিল প্রথম দুই ম্যাচেই।

প্রথম ম্যাচে সুইডেনকে ৭-১ এবং দ্বিতীয় ম্যাচে স্পেনকে ৬-১ গোলে উড়িয়ে দেয় সেলেকাওরা। চার পয়েন্ট নিয়ে পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে চলে আসে ব্রাজিল।অন্যদিকে উরুগুয়ে মোটামুটি ভাগ্যের জোরেই দুই ম্যাচ থেকে পয়েন্ট আদায় করে নেয়। প্রথম ম্যাচে স্পেনের সাথে ২-১ গোলে পিছিয়ে যাওয়ার পর ২-২ গোলে ড্র করতে সক্ষম হয় তারা। দ্বিতীয় ম্যাচে তারা সুইডেনকে ন্যূনতম ব্যবধান ৩-২ গোলে হারায়। জয়সূচক গোলটি এসেছিলো ম্যাচ শেষ হওয়ার পাঁচ মিনিট আগে। দুই রাউন্ড শেষে তিন পয়েন্ট নিয়ে উরুগুয়ে চলে আসে টেবিলের দ্বিতীয় অবস্থানে। সে হিসেবে শেষ রাউন্ডের ব্রাজিল বনাম উরুগুয়ে ম্যাচটি অলিখিত ফাইনালে রূপ নেয়। শিরোপা জয়ের জন্য উরুগুয়ের ব্রাজিলকে হারানো ছাড়া কোনো বিকল্প ছিলো না। অন্যদিকে শুধুমাত্র হার এড়ালেই প্রথমবারের মতো ঘরের মাঠের দর্শকের সামনে জুলে রিমে ট্রফি উঁচিয়ে ধরতে পারতো ব্রাজিল।


ফাইনাল ম্যাচের আগে আগেই সংবাদমাধ্যমগুলো ব্রাজিলকে অগ্রিম চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করে বড় বড় শিরোনাম করে ফেলে। ২২টি গোল্ড মেডেলও ব্রাজিলের খেলোয়াড়দের নাম খোদাই করা হয়ে গিয়েছিলো ম্যাচ শুরুর আগে। ফাইনাল শুরু হওয়ার দু’ঘণ্টা আগে দেওয়া বক্তব্যে রিও ডি জেনেইরোর মেয়র পর্যন্ত ‘চ্যাম্পিয়ন’ সম্বোধন করেন ব্রাজিলের ফুটবল টিমকে। ‘Brasil os Vencedores’ নামে একটি গান রচনা করা হয় ম্যাচ শেষে গাওয়ার জন্য। অবশ্য পুরো ব্যাপারটি অযৌক্তিক কিছু ছিলো না।প্রথমত, রবিন রাউন্ডের দুই ম্যাচেই দুই দলের শক্তির বিস্তর ফারাকের ব্যাপারটা বোঝা গিয়েছিলো। যেখানে ব্রাজিল প্রতিপক্ষকে স্রেফ উড়িয়ে দিয়েছে, সেখানে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে জিতেছিলো ব্রাজিলের প্রতিবেশী দেশ উরুগুয়ে।

দ্বিতীয়ত, আগের বছরেই ব্রাজিলের মাঠে অনুষ্ঠিত হওয়া কোপা আমেরিকা চ্যাম্পিয়নও ছিলো ব্রাজিল। শুধু চ্যাম্পিয়ন বললে ভুল হবে, রীতিমতো শাসন করেছে প্রতিটি দলকেই। সেই টুর্নামেন্টে ৮ ম্যাচে ৪৬ গোল করেছিলো সেলেকাওরা। ফাইনালে প্যারাগুয়েকে হারিয়েছিলো ৭-০ গোলে। বলা বাহুল্য, উরুগুয়েকেও তারা গ্রুপ পর্বের ম্যাচে ৫-১ গোলে হারিয়েছিলো। আক্রমণাত্মক মনোভাব নিয়ে খেলতে নামা ব্রাজিলের সাথে উরুগুয়ে কত গোল হজম করে, সেটাই ছিলো ফাইনালের আগে মুখ্য বিষয়।


ফাইনাল ম্যাচের আগের দিন ব্রাজিলের তৎকালীন বিখ্যাত দৈনিক ও মুন্ডো ব্রাজিল টিমের ছবি দিয়ে শিরোনাম করেছিলো ‘These are the Champions!’। উরুগুয়ে অধিনায়ক ওব্দুলিও ভারেলা যতগুলো কপি পারা যায়, সব কিনে আনেন। তারপর সেগুলো নিজেদের বাথরুমের ফ্লোরে বিছিয়ে সতীর্থদের সেগুলোর উপর মূত্র বিসর্জন করতে উৎসাহিত করেন।

ম্যাচের আগে ট্যাকটিস হিসেবে উরুগুইয়ান কোচ জুয়ান লোপেজ ডিফেন্সিভ খেলার জন্য দিক নির্দেশনা দেন। কোচ চলে যাওয়ার পর ভারেলা উঠে দাঁড়ান। দলের উদ্দেশে তিনি বলেন যে, জুয়ান লোপেজ একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। তবে আজ তার কথা শুনলে আমাদের অবস্থাও হবে স্পেন, সুইডেনের মতো। তারপর নিজেদের খেলোয়াড়দের প্রতি তিনি একটি আবেগময় বক্তব্যও রাখেন। এই বক্তব্যটিই তাঁতিয়ে দেয় উরুগুইয়ানদের।


১৯৫০ সাল, ১৬ জুলাই। রিও ডি জেনেইরোর রাস্তায় সাজ সাজ রব। সাম্বা নাচে তখন উত্তাল পুরো ব্রাজিল। তৎকালীন সবচেয়ে বড় স্টেডিয়াম মারাকানাতে ভিড় জমাতে শুরু করে মানুষ। ২ লক্ষ ধারণ ক্ষমতার স্টেডিয়ামটিতে উপস্থিত হয় ১,৯৯,৮৫৪ জন মানুষ। সবাই ব্রাজিলের জয়োৎসবে যোগদান করার নিমিত্তেই আসে বিখ্যাত এই স্টেডিয়ামটিতে।ম্যাচ শুরুর হুইসেলের পর চিরাচরিত আক্রমণাত্মক ব্রাজিলকেই দেখা যায়। পুরো প্রথম হাফ জুড়ে উরুগুয়েকে ব্রাজিলের আক্রমণ আটকাতেই ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। তবুও স্পেন আর সুইডেনের মতো অবস্থা হয়নি উরুগুয়ের। কোনো গোল না খেয়েই প্রথমার্ধ শেষ করতে সক্ষম হয় দলটি। তবে দ্বিতীয়ার্ধে এসে দুই মিনিটের মাথায় গোল পেয়ে যায় সেলেকাওরা। সাও পাওলো স্ট্রাইকার ফ্রিয়াকার গোলে এগিয়ে যায় ব্রাজিল। গোল খাওয়ার পরও দমে যাননি উরুগুয়ে অধিনায়ক ভারেলা। বল নিয়ে সেন্টারে গিয়ে নিজেদের খেলোয়াড়দের উদ্দেশে চিৎকার করে বলেন, “এখনই সময় জেতার।” অধিনায়কের কথায় জেগে উঠে উরুগুয়ে। হঠাৎ করে পাল্টা আক্রমণাত্মক খেলা শুরু করে উরুগুয়ে। পুরো টুর্নামেন্টে এরকম আক্রমণ আটকাতে হয়নি ব্রাজিল ডিফেন্সকে। হঠাৎ করে আসা উরুগুইয়ান অ্যাটাকে মোটামুটি হকচকিয়েই যায় ব্রাজিল ডিফেন্স। হকচকিয়ে যাওয়া ডিফেন্সকে হতভম্ব করে ৬৬ মিনিটে গোল করে উরুগুয়েকে সমতায় ফেরান জুয়ান আলবার্তো শিফিয়ানো। তবে পুরো স্টেডিয়াম আর ব্রাজিলকে চূড়ান্তভাবে স্তব্ধ করেন আলসিডেস ঘিগিয়া। ম্যাচ শেষ হওয়ার ১১ মিনিট আগে ব্রাজিলের জালে বল জড়ান তিনি। তার এই মহামূল্যবান গোলটির পাস এসেছিলো উরুগুয়ের ‘এল কাপিতানো’ খ্যাত ভারেলার পা থেকে। ব্রাজিল গোলকিপার বারবোসার পায়ের নিচ দিয়ে নেওয়া লো শটে তিনি এনে দেন উরুগুয়ের বহু আরাধ্য গোলটি। পুরা স্টেডিয়াম নিশ্চুপ হয়ে যায় ঘিগিয়ার গোলের পর। যেটিকে পরবর্তীতে ঘিগিয়া বলেছিলেন ‘The sound of silence’। এরপরের শত চেষ্টাতেও গোলের দেখা পায়নি ব্রাজিল। ইংলিশ রেফারি জর্জ রিডারের শেষ হুইসেলে উরুগুয়ে জিতে নেয় নিজেদের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ ট্রফি। ভারেলা এবং ঘিগিয়া বনে যান উরুগুয়ের জাতীয় বীর।







“ব্রাজিলে যেকোনো অন্যায়ের সর্বোচ্চ শাস্তি ৩০ বছর। কিন্তু ৪৪ বছর হয়ে গেলো আমি এখনো শাস্তি ভোগ করে যাচ্ছি, যদিও আমি কোনো অন্যায় করিনি।”

সেই বিশ্বকাপের ৪৪ বছর পর আক্ষেপ নিয়ে বলছিলেন ফাইনালের ব্রাজিলিয়ান গোলরক্ষক বারবোসা। ফাইনালের পর থেকে একরকম নিঃগৃহীতই ছিলেন তিনি। ফাইনালে পরা সাদা জার্সিটিও অভিশপ্ত জার্সি হিসেবে আখ্যা পায়। জনগণের দাবিতে বাধ্য হয়ে ব্রাজিলিয়ান ফুটবল ফেডারেশন চিরতরে জার্সিটির রং পরিবর্তন করে ফেলে।

১৯৫০ সালে সেই ফাইনালের সময় পেলের বয়স ছিলো মাত্র নয়। পরবর্তীতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পেলে বলেছিলেন, তিনি তার বাবাকে একদিন কাঁদতে দেখেন। কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে তার বাবা বলেছিলেন, “আমরা বিশ্বকাপ ফাইনাল হেরে গেছি।” পেলে উত্তর দিয়েছিলেন, “কেঁদো না বাবা, আমি ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ এনে দেবো।” আট বছর পর ১৭ বছর বয়সী পেলে ব্রাজিলকে এনে দেন প্রথম বিশ্বকাপ। পরবর্তীতে জেতান আরো দুটি। পাঁচটি বিশ্বকাপ নিয়ে ব্রাজিল বর্তমানে বিশ্বকাপের সবচেয়ে সফল দল। তবুও বিশ্বকাপের নামে ব্রাজিলে একটি হাহাকার কান পাতলেই শোনা যায়। মারাকানাজো!

 ::::----:::ফেসবুক থেকে সংগৃহীত::::----

No comments