অস্থিতিশীল বাংলাদেশ : উত্তরণের উপায়
রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কুৎসিত চরিত্র :
রাজনৈতিক নেতাদের আসল চরিত্র ফুটে উঠে নির্বাচনের সময়। তারা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য হেন কাজ নেই যা করতে পারে না। যেমন আজকে মতিয়া চৌধুরী, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন হলেন বর্তমান সরকারের পরম বন্ধু ও অভিভাবক। তারা একই মঞ্চে বসে দেশ পরিচালনা করছেন। আর জামায়াত হল তাদের চরম শত্রু। অথচ এক সময় জাসদের হাযার হাযার তরুণকে বঙ্গবন্ধুর রক্ষীবাহিনী হত্যা করেছিল। অন্যদিকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে গণবাহিনী সৃষ্টি করে বহু আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে যার হাত এক সময় রক্তাক্ত হয়েছিল, সেই হাসানুল হক ইনুই এখন আওয়ামী লীগের কর্ণধার। আজকের কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, ১৯৭৩ সালে বায়তুল মুকাররমের এক জনসভায় ভাষণে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবের চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজাব’। যারা গোপনে বঙ্গবন্ধুর শত্রু বা বৈরী ছিল, এখন তারাই আওয়ামী সরকারের সবচেয়ে বেশী প্রিয় ও কাছের মানুষ। গত ১৫ বছর পূর্বেও জামায়াত ছিল আওয়ামী লীগের সুহৃদ বন্ধু। ১৯৮৬ সালে এরশাদের পাতানো নির্বাচনে বিএনপিকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত একসঙ্গে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। এরপরই এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াত একসঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করেছেন। এরূপ কৃৎসিত চরিত্রের প্রশংসা করার ভাষা খুঁজে পাওয়া যাবে কি? জামায়াত বিএনপিকে সমর্থন দিলে তাদের উপর আওয়ামী লীগ ক্ষুব্ধ হয়। ফলে ১৯৯২ সালে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ‘ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠন করে গোলাম আযমের ফাঁসির দাবীতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সামনে গণ আদালত বসানো হয়। সে কারণেই বিএনপি সরকার জামায়াতের গোলাম আযমকে গ্রেফতার করে। তখন বিএনপির উপর জামায়াত ক্ষুব্ধ হয়। ফলে ১৯৯৬ সালে বিএনপির বিরুদ্ধে যৌথ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে জামায়াত ও আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা গোলাম আযমকে তাসবীহ, জায়নামায ও কুরআন মাজীদ উপহার দিয়ে দো‘আ নেন। এই হল আমাদের দেশের সেক্যুলার ও ইসলামী রাজনীতির প্রকৃত চরিত্র। ক্ষমতার মোহে কে স্বৈরাচার, কে দেশদ্রোহী, কে যুদ্ধাপরাধী, কে সন্ত্রাসী পরস্পরকে চিনতে পারে না। সময়ে সবাই একাকার হয়ে যায়।
১৯৯৬ সালে বিএনপির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও জাতীয় পার্টি যুগপৎ আন্দোলন করে। দেশে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ফলে বিএনপির পতন হয়। সেই জামায়াতই আজ বিএনপির প্রাণের বন্ধু আর আওয়ামী লীগের জানের শত্রু। সে শত্রুতা এমনই যে, আওয়ামী লীগ জামায়াত নেতাদের একে একে ফাঁসিতে ঝুলানোর আয়োজন সম্পন্ন করে ফেলেছে। ইতিমধ্যেই জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করেছে। কাজেই চলমান রাজনীতি হল ‘সঙ্গে থাকলে সঙ্গী আর বিরোধী হলে জঙ্গী’। ফলে সঙ্গীকে রক্ষা করতে এবং জঙ্গী অর্থাৎ বিরোধীকে দমন করতে মাঠে নেমেছে রাজনৈতিক নেতা নামধারী গু-ারা। এই চরিত্রহীন রাজনীতিতে বন্দী হয়ে মানুষ আজ দিশেহারা (তথ্য : তাওহীদের ডাক, মে-জুন ২০১৩)।
রাজনৈতিক অস্থিরতা :
বাংলাদেশ এখন এক মৃত্যুপুরিতে পরিণত হয়েছে। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ ও শিশু-কিশোর সবাই জীবনযাপন করছে মহা আতঙ্কে। যার মূল কারণ রাজনৈতিক অস্থিরতা। এর প্রভাব পড়েছে আইন-শৃঙ্খলা, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা প্রভৃতি সেক্টরে। বিরোধী দলের ডাকা সিরিজ হরতাল-অবরোধ এবং ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ দেশের উন্নয়ন কর্মসূচীতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। হরতালের আওতার বাইরে থাকা অ্যাম্বুলেন্সও আক্রমণ থেকে রেহায় পাচ্ছে না। আদালতের নথি, ফেরি, ট্রেন ও লঞ্চে আগুন দেওয়া হচ্ছে। সংবাদ মাধ্যমের অফিস, গাড়ি বোমা হামলার শিকার হচ্ছে। দায়িত্বপালনরত সাংবাদিকও আহত হচ্ছেন। অথচ যেকোনো মৃত্যুই বেদনার, যেকোনো নৈরাজ্যই নিন্দনীয়।
হরতাল এদেশে নতুন কোন রাজনৈতিক কর্মসূচী নয়। শোনা যায় বৃটিশ আমলে মিঃ গান্ধী এদেশের মানুষকে সর্বপ্রথম সাধারণ ধর্মঘটের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তারপর থেকে বাংলাদেশে হরতাল একটা কমন ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। যেকোন কারণে বিরোধী দল প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য হরতাল আহবান করে থাকে। এতে প্রতিপক্ষের কিছু হোক বা নাহোক। ক্ষতি হয় সাধারণ জনগণের। নেতাদের কাজ হল শুধু হরতাল আহবান করা। তারপর এয়ারকান্ডিশন রুমে শুয়ে কিংবা বসে টিভি দেখে সময় কাটান। আর সাধারণ কর্মীরা রাস্তা-ঘাটে, মাঠে-ময়দানে কিছু প্রাপ্তির লোভে জীবন বিলিয়ে দেয়। হরতাল শেষে তারা বলেন, হরতাল সফল হয়েছে। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছে। এই হল রাজনৈতিক নেতাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আসল চেহারা। এক পরিসংখ্যানে জানা যায় যে, ১৯৯১-৯৬ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে রাজনৈতিক সহিংসতায় ১৭৪ জন মারা যায়। ১৯৯৬-২০০১ আওয়ামী লীগের প্রথম শাসনামলে মারা যায় ৭৬৭ জন মানুষ। বিএনপি দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকাকালে ২০০১-২০০৭ সালে হরতাল সহ অন্যান্য কারণে মৃত্যুবরণ করে ৮৭১ জন। তত্ত্বাবধায়ক আমলে ২০০৭-০৮ সালে মারা যায় ১১ জন। এবার আওয়ামী লীগ আমলে ২০০৯ থেকে ৮ নভেম্বর ২০১৩ সাল পর্যন্ত মারা গেছে ৫৬৪ জন। হরতালের সহিংসতায় গত ২৬ অক্টোবর থেকে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত মোট ১০ দিনে নিহত হয়েছে ২৭ জন, আহত হয়েছে এক হাযারেরও বেশি। ককটেল, পেট্রোল, বোমায় অগ্নিদগ্ধ হয়েছে ৭৬ জন। এদের মধ্যে ১৩ শিশু ও তিনজন প্রতিবন্ধী রয়েছে। শুধু আগুনে পুড়েই মারা গেছে ৬ জন। ৪৯০টি যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়েছে। দেড় হাযারের বেশি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটেছে এবং উদ্ধার হয়েছে আট শতাধিক (দৈনিক সকালের খবর, ১৭ নভেম্বর ২০১৩)।
এখন আবার হরতালের আগের দিনও ভয়-ভীতি দেখানোর জন্য নানা হিংসাত্মক কর্মকান্ড চালানো হয়। এছাড়া দলের কর্মী এবং ছোট নেতারা শীর্ষ নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এ ধরনের হরতালের সহিংসতার কাজে লিপ্ত হয়ে থাকে বলে শোনা যায়। এমনও দেখা গেছে গাড়িতে আগুন দিয়ে তা নিজের মোবাইল ফোনে ভিডিও করে পাঠানো হয় নেতার কাছে। এ ধরনের কর্মকান্ড দলে ভবিষ্যৎ উচ্চপদ পাওয়ার ‘যোগ্যতা’ হিসাবে বিবেচিত হয়। শুধু বিরোধী দল নয়, ক্ষমতাসীন দলের অনেক কর্মীর একই ধরনের মানসিকতা রয়েছে। পুরান ঢাকায় দর্জি দোকানের কর্মচারী বিশ্বজিত হত্যার ঘটনা যার জাজ্বল্য প্রমাণ। যে রাজনীতি কল্যাণের কথা চিন্তা না করে মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করে এবং দলের ‘ভাল’ পদ পাওয়ার লিপ্সা দেখায়, সে রাজনীতি মানুষের কতটা কল্যাণ বয়ে আনতে পারবে?
শুধু তাই নয়, যানবাহনে বোম হামলা আর অগ্নি সংযোগের কারণে সিএনজি চালক, দিনমজুর প্রাণ হারাচ্ছে, চোখ হারাচ্ছে। ককটেলের আঘাতে শিশুর হাত উধাও হয়ে যাচ্ছে। মিডিয়ায় বাবার পোড়া বুকে ১৮ মাসের ঘুমন্ত মেয়ে মরিয়মের ছবিটি দেখে দেশের মানুষ প্রশ্নবিদ্ধ, আসলে রাজনীতি কার জন্য?’ যদিও রাজনীতিবিদরা বলে থাকেন, দেশ ও জনগণের স্বার্থরক্ষায় তাদের রাজনীতি। কিন্তু এ রাজনীতি যদি চলন্ত বা স্থির বাসে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়, যদি হয় সিএনজি চালিত অটোরিকশায় পেট্রোল বোমা ছুড়ে চালককে জীবন্ত দগ্ধ করা, যদি হয় রাস্তাঘাটে ককটেল রেখে শিশুসহ পথচারীদের ঝলসে দেওয়া, তাহলে সেই রাজনীতি দেশ ও মানুষের অভিশাপ।
অর্থনৈতিক ক্ষতি :
যে কোন দেশের সার্বিক উন্নতির পূর্বশর্ত হ’ল অর্থনৈতিক উন্নয়ন। আর সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নতির পূর্বশর্ত হচ্ছে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমাদের দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার নামে চলছে রাজনৈতিক বিপর্যয়। এতে দেশ ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছে। এক দিনের হরতালে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির কী ক্ষতি হচ্ছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। যদিও ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (ডিসিসিআই) এক পরিসংখ্যানে বলেছে, এক দিনের হরতালে ক্ষতি হয় ১ হাযার ৬০০ কোটি টাকা। বিজিএমই-এর তথ্য মতে, একদিনের হরতালে পোশাক খাতে ক্ষতির পরিমাণ ১৪০ কোটি টাকা। পরিবহণ মালিকদের মতে, গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকায় ১ দিনে কমপক্ষে ২৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। ক্ষয়-ক্ষতির হিসাব কম-বেশি যেটাই হোক, হরতাল দেশের অর্থনীতির মেরুদ- ভেঙে দিচ্ছে। গাড়ি-ঘোড়া চলছে না। আমদানী-রফতানী বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এখন দফায় দফায় টানা তিন, চার দিন কিংবা এক সপ্তাহ অবরোধ কর্মসূচীতে দেশের অর্থনীতি সর্বনাশের দিকে এগিয়ে চলেছে। একদিকে যেমন কৃষকের কষ্টের ফসল নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে হু হু করে বাড়ছে দ্রব্যমূল্য। শিল্প, কল-কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আগের হরতালের চেয়ে এখন ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশী।
সম্ভাবনাময় গার্মেন্টস শিল্পে গত কয়েক বছরে নানা বিপর্যয়ের পর এখন রাজনৈতিক অস্থিরতা ও হাঙ্গামায় অবস্থা শোচনীয়। হরতালের কারণে রফতানিযোগ্য গার্মেন্টস পণ্য যথাসময়ে শিপমেন্ট করা সম্ভব হচ্ছে না। বিলম্বিত সরবরাহের কারণে বিদেশী আমদানিকারকরা বিরক্ত হচ্ছে। ইতিমধ্যে তারা বাংলাদেশের বিকল্প গার্মেন্টস রফতানিকারক দেশের সন্ধানে রয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার কারণে গার্মেন্টস ক্রেতারা বাংলাদেশে এসে এয়ারপোর্ট থেকে আবার ফিরে গেছে। এমন ঘটনা হরদম ঘটছে। এভাবে দেশীয় অর্থনীতির অন্যতম অনুষঙ্গ গার্মেন্ট শিল্পের সম্ভাবনার দুয়ারগুলো বন্ধ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে ক্ষতি :
শিক্ষাই জাতির মেরুদ-। ছাত্ররাই জাতির ভবিষ্যৎ। এই ভবিষ্যৎ নাগরিকদেরকে গড়ে তোলার প্রধান কারিগর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু আজকে সেই শিক্ষাঙ্গন নানা সমস্যায় জর্জরিত। গণতন্ত্রের অশুভ থাবা, বস্তাপচা রাজনীতির হিংস্র ছোবলে শিক্ষাঙ্গন কলুষিত। তথাকথিত ছাত্র রাজনীতির নামে ছাত্র নেতারা শিক্ষাঙ্গনে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ও বড় বড় কলেজগুলোতে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারের নামে সাধারণ শিক্ষার্থীদের হয়রানি, শারীরিক ও মানসিক টর্চার, চোরাগুপ্তা হামলা, হাত-পায়ের রগ কর্তনসহ হত্যার মত জঘন্য কাজ তারা করে যাচ্ছে। এহেন অবস্থায় ছাত্রদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্ট কালের জন্য ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীরা সেশনজটে পড়ছে এবং তাদের লেখা-পড়ায় বিঘ্ন ঘটছে। রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের আধিপত্য বিস্তার ও ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কোমলমতি ছাত্রদের হাতে নির্দ্ধিধায় অস্ত্র তুলে দিচ্ছে এবং তাদেরকে ব্যবহার করছে।
একদিকে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সব পরীক্ষা শেষ করার জন্য নির্বাচন কমিশনের তাকীদ ও সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হল ভ্যাকান্ট করার পায়তারা, অন্যদিকে দাবি আদায়ে বিরোধী দলের লাগাতার হরতাল-অবরোধ ও অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা। এই দুই মিলিয়ে পরীক্ষার সময়সূচী নিয়ে বিপাকে পড়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ। আর এই পরীক্ষার প্রস্ত্ততি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে প্রথম শ্রেণী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রেণী ও বর্ষে অধ্যয়নরত দেশের প্রায় সাড়ে ৩ কোটি শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকরা। কারণ এবারে জেডিসি ও জেএসসি নামে বড় দু’টি পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে, একের পর এক হরতাল-অবরোধের মধ্যে। ফলে নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হয়নি। দেশের সরকারী ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েরও বেহাল অবস্থা। বারবার পরীক্ষার সিডিউল পরিবর্তন করা হচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের মানসিক মনোবল হারিয়ে হতাশা ও দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। অভিভাবকগণও তাদের সন্তানদের অনাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্নে দিন কাটাচ্ছে। হরতালের কারণে নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে স্কুলেও যেতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। আর শিক্ষার্থীরা না আসায় পড়াতেও পারছেন না শিক্ষকরা। সিলেবাসও শেষ হচ্ছে না।
- See more at: http://tawheederdak.at-tahreek.com/november-december2013/article11.html#sthash.B9M44zQY.dpuf
রাজনৈতিক নেতাদের আসল চরিত্র ফুটে উঠে নির্বাচনের সময়। তারা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য হেন কাজ নেই যা করতে পারে না। যেমন আজকে মতিয়া চৌধুরী, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন হলেন বর্তমান সরকারের পরম বন্ধু ও অভিভাবক। তারা একই মঞ্চে বসে দেশ পরিচালনা করছেন। আর জামায়াত হল তাদের চরম শত্রু। অথচ এক সময় জাসদের হাযার হাযার তরুণকে বঙ্গবন্ধুর রক্ষীবাহিনী হত্যা করেছিল। অন্যদিকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে গণবাহিনী সৃষ্টি করে বহু আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে যার হাত এক সময় রক্তাক্ত হয়েছিল, সেই হাসানুল হক ইনুই এখন আওয়ামী লীগের কর্ণধার। আজকের কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, ১৯৭৩ সালে বায়তুল মুকাররমের এক জনসভায় ভাষণে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবের চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজাব’। যারা গোপনে বঙ্গবন্ধুর শত্রু বা বৈরী ছিল, এখন তারাই আওয়ামী সরকারের সবচেয়ে বেশী প্রিয় ও কাছের মানুষ। গত ১৫ বছর পূর্বেও জামায়াত ছিল আওয়ামী লীগের সুহৃদ বন্ধু। ১৯৮৬ সালে এরশাদের পাতানো নির্বাচনে বিএনপিকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত একসঙ্গে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। এরপরই এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াত একসঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করেছেন। এরূপ কৃৎসিত চরিত্রের প্রশংসা করার ভাষা খুঁজে পাওয়া যাবে কি? জামায়াত বিএনপিকে সমর্থন দিলে তাদের উপর আওয়ামী লীগ ক্ষুব্ধ হয়। ফলে ১৯৯২ সালে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ‘ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠন করে গোলাম আযমের ফাঁসির দাবীতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সামনে গণ আদালত বসানো হয়। সে কারণেই বিএনপি সরকার জামায়াতের গোলাম আযমকে গ্রেফতার করে। তখন বিএনপির উপর জামায়াত ক্ষুব্ধ হয়। ফলে ১৯৯৬ সালে বিএনপির বিরুদ্ধে যৌথ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে জামায়াত ও আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা গোলাম আযমকে তাসবীহ, জায়নামায ও কুরআন মাজীদ উপহার দিয়ে দো‘আ নেন। এই হল আমাদের দেশের সেক্যুলার ও ইসলামী রাজনীতির প্রকৃত চরিত্র। ক্ষমতার মোহে কে স্বৈরাচার, কে দেশদ্রোহী, কে যুদ্ধাপরাধী, কে সন্ত্রাসী পরস্পরকে চিনতে পারে না। সময়ে সবাই একাকার হয়ে যায়।
১৯৯৬ সালে বিএনপির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও জাতীয় পার্টি যুগপৎ আন্দোলন করে। দেশে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ফলে বিএনপির পতন হয়। সেই জামায়াতই আজ বিএনপির প্রাণের বন্ধু আর আওয়ামী লীগের জানের শত্রু। সে শত্রুতা এমনই যে, আওয়ামী লীগ জামায়াত নেতাদের একে একে ফাঁসিতে ঝুলানোর আয়োজন সম্পন্ন করে ফেলেছে। ইতিমধ্যেই জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করেছে। কাজেই চলমান রাজনীতি হল ‘সঙ্গে থাকলে সঙ্গী আর বিরোধী হলে জঙ্গী’। ফলে সঙ্গীকে রক্ষা করতে এবং জঙ্গী অর্থাৎ বিরোধীকে দমন করতে মাঠে নেমেছে রাজনৈতিক নেতা নামধারী গু-ারা। এই চরিত্রহীন রাজনীতিতে বন্দী হয়ে মানুষ আজ দিশেহারা (তথ্য : তাওহীদের ডাক, মে-জুন ২০১৩)।
রাজনৈতিক অস্থিরতা :
বাংলাদেশ এখন এক মৃত্যুপুরিতে পরিণত হয়েছে। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ ও শিশু-কিশোর সবাই জীবনযাপন করছে মহা আতঙ্কে। যার মূল কারণ রাজনৈতিক অস্থিরতা। এর প্রভাব পড়েছে আইন-শৃঙ্খলা, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা প্রভৃতি সেক্টরে। বিরোধী দলের ডাকা সিরিজ হরতাল-অবরোধ এবং ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ দেশের উন্নয়ন কর্মসূচীতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। হরতালের আওতার বাইরে থাকা অ্যাম্বুলেন্সও আক্রমণ থেকে রেহায় পাচ্ছে না। আদালতের নথি, ফেরি, ট্রেন ও লঞ্চে আগুন দেওয়া হচ্ছে। সংবাদ মাধ্যমের অফিস, গাড়ি বোমা হামলার শিকার হচ্ছে। দায়িত্বপালনরত সাংবাদিকও আহত হচ্ছেন। অথচ যেকোনো মৃত্যুই বেদনার, যেকোনো নৈরাজ্যই নিন্দনীয়।
হরতাল এদেশে নতুন কোন রাজনৈতিক কর্মসূচী নয়। শোনা যায় বৃটিশ আমলে মিঃ গান্ধী এদেশের মানুষকে সর্বপ্রথম সাধারণ ধর্মঘটের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তারপর থেকে বাংলাদেশে হরতাল একটা কমন ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। যেকোন কারণে বিরোধী দল প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য হরতাল আহবান করে থাকে। এতে প্রতিপক্ষের কিছু হোক বা নাহোক। ক্ষতি হয় সাধারণ জনগণের। নেতাদের কাজ হল শুধু হরতাল আহবান করা। তারপর এয়ারকান্ডিশন রুমে শুয়ে কিংবা বসে টিভি দেখে সময় কাটান। আর সাধারণ কর্মীরা রাস্তা-ঘাটে, মাঠে-ময়দানে কিছু প্রাপ্তির লোভে জীবন বিলিয়ে দেয়। হরতাল শেষে তারা বলেন, হরতাল সফল হয়েছে। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছে। এই হল রাজনৈতিক নেতাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আসল চেহারা। এক পরিসংখ্যানে জানা যায় যে, ১৯৯১-৯৬ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে রাজনৈতিক সহিংসতায় ১৭৪ জন মারা যায়। ১৯৯৬-২০০১ আওয়ামী লীগের প্রথম শাসনামলে মারা যায় ৭৬৭ জন মানুষ। বিএনপি দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকাকালে ২০০১-২০০৭ সালে হরতাল সহ অন্যান্য কারণে মৃত্যুবরণ করে ৮৭১ জন। তত্ত্বাবধায়ক আমলে ২০০৭-০৮ সালে মারা যায় ১১ জন। এবার আওয়ামী লীগ আমলে ২০০৯ থেকে ৮ নভেম্বর ২০১৩ সাল পর্যন্ত মারা গেছে ৫৬৪ জন। হরতালের সহিংসতায় গত ২৬ অক্টোবর থেকে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত মোট ১০ দিনে নিহত হয়েছে ২৭ জন, আহত হয়েছে এক হাযারেরও বেশি। ককটেল, পেট্রোল, বোমায় অগ্নিদগ্ধ হয়েছে ৭৬ জন। এদের মধ্যে ১৩ শিশু ও তিনজন প্রতিবন্ধী রয়েছে। শুধু আগুনে পুড়েই মারা গেছে ৬ জন। ৪৯০টি যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়েছে। দেড় হাযারের বেশি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটেছে এবং উদ্ধার হয়েছে আট শতাধিক (দৈনিক সকালের খবর, ১৭ নভেম্বর ২০১৩)।
এখন আবার হরতালের আগের দিনও ভয়-ভীতি দেখানোর জন্য নানা হিংসাত্মক কর্মকান্ড চালানো হয়। এছাড়া দলের কর্মী এবং ছোট নেতারা শীর্ষ নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এ ধরনের হরতালের সহিংসতার কাজে লিপ্ত হয়ে থাকে বলে শোনা যায়। এমনও দেখা গেছে গাড়িতে আগুন দিয়ে তা নিজের মোবাইল ফোনে ভিডিও করে পাঠানো হয় নেতার কাছে। এ ধরনের কর্মকান্ড দলে ভবিষ্যৎ উচ্চপদ পাওয়ার ‘যোগ্যতা’ হিসাবে বিবেচিত হয়। শুধু বিরোধী দল নয়, ক্ষমতাসীন দলের অনেক কর্মীর একই ধরনের মানসিকতা রয়েছে। পুরান ঢাকায় দর্জি দোকানের কর্মচারী বিশ্বজিত হত্যার ঘটনা যার জাজ্বল্য প্রমাণ। যে রাজনীতি কল্যাণের কথা চিন্তা না করে মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করে এবং দলের ‘ভাল’ পদ পাওয়ার লিপ্সা দেখায়, সে রাজনীতি মানুষের কতটা কল্যাণ বয়ে আনতে পারবে?
শুধু তাই নয়, যানবাহনে বোম হামলা আর অগ্নি সংযোগের কারণে সিএনজি চালক, দিনমজুর প্রাণ হারাচ্ছে, চোখ হারাচ্ছে। ককটেলের আঘাতে শিশুর হাত উধাও হয়ে যাচ্ছে। মিডিয়ায় বাবার পোড়া বুকে ১৮ মাসের ঘুমন্ত মেয়ে মরিয়মের ছবিটি দেখে দেশের মানুষ প্রশ্নবিদ্ধ, আসলে রাজনীতি কার জন্য?’ যদিও রাজনীতিবিদরা বলে থাকেন, দেশ ও জনগণের স্বার্থরক্ষায় তাদের রাজনীতি। কিন্তু এ রাজনীতি যদি চলন্ত বা স্থির বাসে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়, যদি হয় সিএনজি চালিত অটোরিকশায় পেট্রোল বোমা ছুড়ে চালককে জীবন্ত দগ্ধ করা, যদি হয় রাস্তাঘাটে ককটেল রেখে শিশুসহ পথচারীদের ঝলসে দেওয়া, তাহলে সেই রাজনীতি দেশ ও মানুষের অভিশাপ।
অর্থনৈতিক ক্ষতি :
যে কোন দেশের সার্বিক উন্নতির পূর্বশর্ত হ’ল অর্থনৈতিক উন্নয়ন। আর সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নতির পূর্বশর্ত হচ্ছে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমাদের দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার নামে চলছে রাজনৈতিক বিপর্যয়। এতে দেশ ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছে। এক দিনের হরতালে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির কী ক্ষতি হচ্ছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। যদিও ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (ডিসিসিআই) এক পরিসংখ্যানে বলেছে, এক দিনের হরতালে ক্ষতি হয় ১ হাযার ৬০০ কোটি টাকা। বিজিএমই-এর তথ্য মতে, একদিনের হরতালে পোশাক খাতে ক্ষতির পরিমাণ ১৪০ কোটি টাকা। পরিবহণ মালিকদের মতে, গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকায় ১ দিনে কমপক্ষে ২৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। ক্ষয়-ক্ষতির হিসাব কম-বেশি যেটাই হোক, হরতাল দেশের অর্থনীতির মেরুদ- ভেঙে দিচ্ছে। গাড়ি-ঘোড়া চলছে না। আমদানী-রফতানী বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এখন দফায় দফায় টানা তিন, চার দিন কিংবা এক সপ্তাহ অবরোধ কর্মসূচীতে দেশের অর্থনীতি সর্বনাশের দিকে এগিয়ে চলেছে। একদিকে যেমন কৃষকের কষ্টের ফসল নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে হু হু করে বাড়ছে দ্রব্যমূল্য। শিল্প, কল-কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আগের হরতালের চেয়ে এখন ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশী।
সম্ভাবনাময় গার্মেন্টস শিল্পে গত কয়েক বছরে নানা বিপর্যয়ের পর এখন রাজনৈতিক অস্থিরতা ও হাঙ্গামায় অবস্থা শোচনীয়। হরতালের কারণে রফতানিযোগ্য গার্মেন্টস পণ্য যথাসময়ে শিপমেন্ট করা সম্ভব হচ্ছে না। বিলম্বিত সরবরাহের কারণে বিদেশী আমদানিকারকরা বিরক্ত হচ্ছে। ইতিমধ্যে তারা বাংলাদেশের বিকল্প গার্মেন্টস রফতানিকারক দেশের সন্ধানে রয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার কারণে গার্মেন্টস ক্রেতারা বাংলাদেশে এসে এয়ারপোর্ট থেকে আবার ফিরে গেছে। এমন ঘটনা হরদম ঘটছে। এভাবে দেশীয় অর্থনীতির অন্যতম অনুষঙ্গ গার্মেন্ট শিল্পের সম্ভাবনার দুয়ারগুলো বন্ধ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে ক্ষতি :
শিক্ষাই জাতির মেরুদ-। ছাত্ররাই জাতির ভবিষ্যৎ। এই ভবিষ্যৎ নাগরিকদেরকে গড়ে তোলার প্রধান কারিগর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু আজকে সেই শিক্ষাঙ্গন নানা সমস্যায় জর্জরিত। গণতন্ত্রের অশুভ থাবা, বস্তাপচা রাজনীতির হিংস্র ছোবলে শিক্ষাঙ্গন কলুষিত। তথাকথিত ছাত্র রাজনীতির নামে ছাত্র নেতারা শিক্ষাঙ্গনে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ও বড় বড় কলেজগুলোতে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারের নামে সাধারণ শিক্ষার্থীদের হয়রানি, শারীরিক ও মানসিক টর্চার, চোরাগুপ্তা হামলা, হাত-পায়ের রগ কর্তনসহ হত্যার মত জঘন্য কাজ তারা করে যাচ্ছে। এহেন অবস্থায় ছাত্রদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্ট কালের জন্য ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীরা সেশনজটে পড়ছে এবং তাদের লেখা-পড়ায় বিঘ্ন ঘটছে। রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের আধিপত্য বিস্তার ও ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কোমলমতি ছাত্রদের হাতে নির্দ্ধিধায় অস্ত্র তুলে দিচ্ছে এবং তাদেরকে ব্যবহার করছে।
একদিকে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সব পরীক্ষা শেষ করার জন্য নির্বাচন কমিশনের তাকীদ ও সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হল ভ্যাকান্ট করার পায়তারা, অন্যদিকে দাবি আদায়ে বিরোধী দলের লাগাতার হরতাল-অবরোধ ও অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা। এই দুই মিলিয়ে পরীক্ষার সময়সূচী নিয়ে বিপাকে পড়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ। আর এই পরীক্ষার প্রস্ত্ততি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে প্রথম শ্রেণী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রেণী ও বর্ষে অধ্যয়নরত দেশের প্রায় সাড়ে ৩ কোটি শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকরা। কারণ এবারে জেডিসি ও জেএসসি নামে বড় দু’টি পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে, একের পর এক হরতাল-অবরোধের মধ্যে। ফলে নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হয়নি। দেশের সরকারী ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েরও বেহাল অবস্থা। বারবার পরীক্ষার সিডিউল পরিবর্তন করা হচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের মানসিক মনোবল হারিয়ে হতাশা ও দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। অভিভাবকগণও তাদের সন্তানদের অনাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্নে দিন কাটাচ্ছে। হরতালের কারণে নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে স্কুলেও যেতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। আর শিক্ষার্থীরা না আসায় পড়াতেও পারছেন না শিক্ষকরা। সিলেবাসও শেষ হচ্ছে না।
- See more at: http://tawheederdak.at-tahreek.com/november-december2013/article11.html#sthash.B9M44zQY.dpuf
রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কুৎসিত চরিত্র :
রাজনৈতিক নেতাদের আসল চরিত্র ফুটে উঠে নির্বাচনের সময়। তারা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য হেন কাজ নেই যা করতে পারে না। যেমন আজকে মতিয়া চৌধুরী, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন হলেন বর্তমান সরকারের পরম বন্ধু ও অভিভাবক। তারা একই মঞ্চে বসে দেশ পরিচালনা করছেন। আর জামায়াত হল তাদের চরম শত্রু। অথচ এক সময় জাসদের হাযার হাযার তরুণকে বঙ্গবন্ধুর রক্ষীবাহিনী হত্যা করেছিল। অন্যদিকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে গণবাহিনী সৃষ্টি করে বহু আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে যার হাত এক সময় রক্তাক্ত হয়েছিল, সেই হাসানুল হক ইনুই এখন আওয়ামী লীগের কর্ণধার। আজকের কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, ১৯৭৩ সালে বায়তুল মুকাররমের এক জনসভায় ভাষণে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবের চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজাব’। যারা গোপনে বঙ্গবন্ধুর শত্রু বা বৈরী ছিল, এখন তারাই আওয়ামী সরকারের সবচেয়ে বেশী প্রিয় ও কাছের মানুষ। গত ১৫ বছর পূর্বেও জামায়াত ছিল আওয়ামী লীগের সুহৃদ বন্ধু। ১৯৮৬ সালে এরশাদের পাতানো নির্বাচনে বিএনপিকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত একসঙ্গে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। এরপরই এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াত একসঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করেছেন। এরূপ কৃৎসিত চরিত্রের প্রশংসা করার ভাষা খুঁজে পাওয়া যাবে কি? জামায়াত বিএনপিকে সমর্থন দিলে তাদের উপর আওয়ামী লীগ ক্ষুব্ধ হয়। ফলে ১৯৯২ সালে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ‘ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠন করে গোলাম আযমের ফাঁসির দাবীতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সামনে গণ আদালত বসানো হয়। সে কারণেই বিএনপি সরকার জামায়াতের গোলাম আযমকে গ্রেফতার করে। তখন বিএনপির উপর জামায়াত ক্ষুব্ধ হয়। ফলে ১৯৯৬ সালে বিএনপির বিরুদ্ধে যৌথ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে জামায়াত ও আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা গোলাম আযমকে তাসবীহ, জায়নামায ও কুরআন মাজীদ উপহার দিয়ে দো‘আ নেন। এই হল আমাদের দেশের সেক্যুলার ও ইসলামী রাজনীতির প্রকৃত চরিত্র। ক্ষমতার মোহে কে স্বৈরাচার, কে দেশদ্রোহী, কে যুদ্ধাপরাধী, কে সন্ত্রাসী পরস্পরকে চিনতে পারে না। সময়ে সবাই একাকার হয়ে যায়।
১৯৯৬ সালে বিএনপির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও জাতীয় পার্টি যুগপৎ আন্দোলন করে। দেশে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ফলে বিএনপির পতন হয়। সেই জামায়াতই আজ বিএনপির প্রাণের বন্ধু আর আওয়ামী লীগের জানের শত্রু। সে শত্রুতা এমনই যে, আওয়ামী লীগ জামায়াত নেতাদের একে একে ফাঁসিতে ঝুলানোর আয়োজন সম্পন্ন করে ফেলেছে। ইতিমধ্যেই জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করেছে। কাজেই চলমান রাজনীতি হল ‘সঙ্গে থাকলে সঙ্গী আর বিরোধী হলে জঙ্গী’। ফলে সঙ্গীকে রক্ষা করতে এবং জঙ্গী অর্থাৎ বিরোধীকে দমন করতে মাঠে নেমেছে রাজনৈতিক নেতা নামধারী গু-ারা। এই চরিত্রহীন রাজনীতিতে বন্দী হয়ে মানুষ আজ দিশেহারা (তথ্য : তাওহীদের ডাক, মে-জুন ২০১৩)।
রাজনৈতিক অস্থিরতা :
বাংলাদেশ এখন এক মৃত্যুপুরিতে পরিণত হয়েছে। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ ও শিশু-কিশোর সবাই জীবনযাপন করছে মহা আতঙ্কে। যার মূল কারণ রাজনৈতিক অস্থিরতা। এর প্রভাব পড়েছে আইন-শৃঙ্খলা, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা প্রভৃতি সেক্টরে। বিরোধী দলের ডাকা সিরিজ হরতাল-অবরোধ এবং ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ দেশের উন্নয়ন কর্মসূচীতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। হরতালের আওতার বাইরে থাকা অ্যাম্বুলেন্সও আক্রমণ থেকে রেহায় পাচ্ছে না। আদালতের নথি, ফেরি, ট্রেন ও লঞ্চে আগুন দেওয়া হচ্ছে। সংবাদ মাধ্যমের অফিস, গাড়ি বোমা হামলার শিকার হচ্ছে। দায়িত্বপালনরত সাংবাদিকও আহত হচ্ছেন। অথচ যেকোনো মৃত্যুই বেদনার, যেকোনো নৈরাজ্যই নিন্দনীয়।
হরতাল এদেশে নতুন কোন রাজনৈতিক কর্মসূচী নয়। শোনা যায় বৃটিশ আমলে মিঃ গান্ধী এদেশের মানুষকে সর্বপ্রথম সাধারণ ধর্মঘটের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তারপর থেকে বাংলাদেশে হরতাল একটা কমন ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। যেকোন কারণে বিরোধী দল প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য হরতাল আহবান করে থাকে। এতে প্রতিপক্ষের কিছু হোক বা নাহোক। ক্ষতি হয় সাধারণ জনগণের। নেতাদের কাজ হল শুধু হরতাল আহবান করা। তারপর এয়ারকান্ডিশন রুমে শুয়ে কিংবা বসে টিভি দেখে সময় কাটান। আর সাধারণ কর্মীরা রাস্তা-ঘাটে, মাঠে-ময়দানে কিছু প্রাপ্তির লোভে জীবন বিলিয়ে দেয়। হরতাল শেষে তারা বলেন, হরতাল সফল হয়েছে। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছে। এই হল রাজনৈতিক নেতাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আসল চেহারা। এক পরিসংখ্যানে জানা যায় যে, ১৯৯১-৯৬ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে রাজনৈতিক সহিংসতায় ১৭৪ জন মারা যায়। ১৯৯৬-২০০১ আওয়ামী লীগের প্রথম শাসনামলে মারা যায় ৭৬৭ জন মানুষ। বিএনপি দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকাকালে ২০০১-২০০৭ সালে হরতাল সহ অন্যান্য কারণে মৃত্যুবরণ করে ৮৭১ জন। তত্ত্বাবধায়ক আমলে ২০০৭-০৮ সালে মারা যায় ১১ জন। এবার আওয়ামী লীগ আমলে ২০০৯ থেকে ৮ নভেম্বর ২০১৩ সাল পর্যন্ত মারা গেছে ৫৬৪ জন। হরতালের সহিংসতায় গত ২৬ অক্টোবর থেকে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত মোট ১০ দিনে নিহত হয়েছে ২৭ জন, আহত হয়েছে এক হাযারেরও বেশি। ককটেল, পেট্রোল, বোমায় অগ্নিদগ্ধ হয়েছে ৭৬ জন। এদের মধ্যে ১৩ শিশু ও তিনজন প্রতিবন্ধী রয়েছে। শুধু আগুনে পুড়েই মারা গেছে ৬ জন। ৪৯০টি যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়েছে। দেড় হাযারের বেশি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটেছে এবং উদ্ধার হয়েছে আট শতাধিক (দৈনিক সকালের খবর, ১৭ নভেম্বর ২০১৩)।
এখন আবার হরতালের আগের দিনও ভয়-ভীতি দেখানোর জন্য নানা হিংসাত্মক কর্মকান্ড চালানো হয়। এছাড়া দলের কর্মী এবং ছোট নেতারা শীর্ষ নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এ ধরনের হরতালের সহিংসতার কাজে লিপ্ত হয়ে থাকে বলে শোনা যায়। এমনও দেখা গেছে গাড়িতে আগুন দিয়ে তা নিজের মোবাইল ফোনে ভিডিও করে পাঠানো হয় নেতার কাছে। এ ধরনের কর্মকান্ড দলে ভবিষ্যৎ উচ্চপদ পাওয়ার ‘যোগ্যতা’ হিসাবে বিবেচিত হয়। শুধু বিরোধী দল নয়, ক্ষমতাসীন দলের অনেক কর্মীর একই ধরনের মানসিকতা রয়েছে। পুরান ঢাকায় দর্জি দোকানের কর্মচারী বিশ্বজিত হত্যার ঘটনা যার জাজ্বল্য প্রমাণ। যে রাজনীতি কল্যাণের কথা চিন্তা না করে মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করে এবং দলের ‘ভাল’ পদ পাওয়ার লিপ্সা দেখায়, সে রাজনীতি মানুষের কতটা কল্যাণ বয়ে আনতে পারবে?
শুধু তাই নয়, যানবাহনে বোম হামলা আর অগ্নি সংযোগের কারণে সিএনজি চালক, দিনমজুর প্রাণ হারাচ্ছে, চোখ হারাচ্ছে। ককটেলের আঘাতে শিশুর হাত উধাও হয়ে যাচ্ছে। মিডিয়ায় বাবার পোড়া বুকে ১৮ মাসের ঘুমন্ত মেয়ে মরিয়মের ছবিটি দেখে দেশের মানুষ প্রশ্নবিদ্ধ, আসলে রাজনীতি কার জন্য?’ যদিও রাজনীতিবিদরা বলে থাকেন, দেশ ও জনগণের স্বার্থরক্ষায় তাদের রাজনীতি। কিন্তু এ রাজনীতি যদি চলন্ত বা স্থির বাসে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়, যদি হয় সিএনজি চালিত অটোরিকশায় পেট্রোল বোমা ছুড়ে চালককে জীবন্ত দগ্ধ করা, যদি হয় রাস্তাঘাটে ককটেল রেখে শিশুসহ পথচারীদের ঝলসে দেওয়া, তাহলে সেই রাজনীতি দেশ ও মানুষের অভিশাপ।
অর্থনৈতিক ক্ষতি :
যে কোন দেশের সার্বিক উন্নতির পূর্বশর্ত হ’ল অর্থনৈতিক উন্নয়ন। আর সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নতির পূর্বশর্ত হচ্ছে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমাদের দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার নামে চলছে রাজনৈতিক বিপর্যয়। এতে দেশ ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছে। এক দিনের হরতালে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির কী ক্ষতি হচ্ছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। যদিও ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (ডিসিসিআই) এক পরিসংখ্যানে বলেছে, এক দিনের হরতালে ক্ষতি হয় ১ হাযার ৬০০ কোটি টাকা। বিজিএমই-এর তথ্য মতে, একদিনের হরতালে পোশাক খাতে ক্ষতির পরিমাণ ১৪০ কোটি টাকা। পরিবহণ মালিকদের মতে, গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকায় ১ দিনে কমপক্ষে ২৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। ক্ষয়-ক্ষতির হিসাব কম-বেশি যেটাই হোক, হরতাল দেশের অর্থনীতির মেরুদ- ভেঙে দিচ্ছে। গাড়ি-ঘোড়া চলছে না। আমদানী-রফতানী বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এখন দফায় দফায় টানা তিন, চার দিন কিংবা এক সপ্তাহ অবরোধ কর্মসূচীতে দেশের অর্থনীতি সর্বনাশের দিকে এগিয়ে চলেছে। একদিকে যেমন কৃষকের কষ্টের ফসল নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে হু হু করে বাড়ছে দ্রব্যমূল্য। শিল্প, কল-কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আগের হরতালের চেয়ে এখন ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশী।
সম্ভাবনাময় গার্মেন্টস শিল্পে গত কয়েক বছরে নানা বিপর্যয়ের পর এখন রাজনৈতিক অস্থিরতা ও হাঙ্গামায় অবস্থা শোচনীয়। হরতালের কারণে রফতানিযোগ্য গার্মেন্টস পণ্য যথাসময়ে শিপমেন্ট করা সম্ভব হচ্ছে না। বিলম্বিত সরবরাহের কারণে বিদেশী আমদানিকারকরা বিরক্ত হচ্ছে। ইতিমধ্যে তারা বাংলাদেশের বিকল্প গার্মেন্টস রফতানিকারক দেশের সন্ধানে রয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার কারণে গার্মেন্টস ক্রেতারা বাংলাদেশে এসে এয়ারপোর্ট থেকে আবার ফিরে গেছে। এমন ঘটনা হরদম ঘটছে। এভাবে দেশীয় অর্থনীতির অন্যতম অনুষঙ্গ গার্মেন্ট শিল্পের সম্ভাবনার দুয়ারগুলো বন্ধ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে ক্ষতি :
শিক্ষাই জাতির মেরুদ-। ছাত্ররাই জাতির ভবিষ্যৎ। এই ভবিষ্যৎ নাগরিকদেরকে গড়ে তোলার প্রধান কারিগর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু আজকে সেই শিক্ষাঙ্গন নানা সমস্যায় জর্জরিত। গণতন্ত্রের অশুভ থাবা, বস্তাপচা রাজনীতির হিংস্র ছোবলে শিক্ষাঙ্গন কলুষিত। তথাকথিত ছাত্র রাজনীতির নামে ছাত্র নেতারা শিক্ষাঙ্গনে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ও বড় বড় কলেজগুলোতে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারের নামে সাধারণ শিক্ষার্থীদের হয়রানি, শারীরিক ও মানসিক টর্চার, চোরাগুপ্তা হামলা, হাত-পায়ের রগ কর্তনসহ হত্যার মত জঘন্য কাজ তারা করে যাচ্ছে। এহেন অবস্থায় ছাত্রদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্ট কালের জন্য ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীরা সেশনজটে পড়ছে এবং তাদের লেখা-পড়ায় বিঘ্ন ঘটছে। রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের আধিপত্য বিস্তার ও ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কোমলমতি ছাত্রদের হাতে নির্দ্ধিধায় অস্ত্র তুলে দিচ্ছে এবং তাদেরকে ব্যবহার করছে।
একদিকে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সব পরীক্ষা শেষ করার জন্য নির্বাচন কমিশনের তাকীদ ও সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হল ভ্যাকান্ট করার পায়তারা, অন্যদিকে দাবি আদায়ে বিরোধী দলের লাগাতার হরতাল-অবরোধ ও অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা। এই দুই মিলিয়ে পরীক্ষার সময়সূচী নিয়ে বিপাকে পড়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ। আর এই পরীক্ষার প্রস্ত্ততি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে প্রথম শ্রেণী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রেণী ও বর্ষে অধ্যয়নরত দেশের প্রায় সাড়ে ৩ কোটি শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকরা। কারণ এবারে জেডিসি ও জেএসসি নামে বড় দু’টি পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে, একের পর এক হরতাল-অবরোধের মধ্যে। ফলে নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হয়নি। দেশের সরকারী ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েরও বেহাল অবস্থা। বারবার পরীক্ষার সিডিউল পরিবর্তন করা হচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের মানসিক মনোবল হারিয়ে হতাশা ও দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। অভিভাবকগণও তাদের সন্তানদের অনাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্নে দিন কাটাচ্ছে। হরতালের কারণে নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে স্কুলেও যেতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। আর শিক্ষার্থীরা না আসায় পড়াতেও পারছেন না শিক্ষকরা। সিলেবাসও শেষ হচ্ছে না।
রাজনৈতিক নেতাদের আসল চরিত্র ফুটে উঠে নির্বাচনের সময়। তারা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য হেন কাজ নেই যা করতে পারে না। যেমন আজকে মতিয়া চৌধুরী, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন হলেন বর্তমান সরকারের পরম বন্ধু ও অভিভাবক। তারা একই মঞ্চে বসে দেশ পরিচালনা করছেন। আর জামায়াত হল তাদের চরম শত্রু। অথচ এক সময় জাসদের হাযার হাযার তরুণকে বঙ্গবন্ধুর রক্ষীবাহিনী হত্যা করেছিল। অন্যদিকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে গণবাহিনী সৃষ্টি করে বহু আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে যার হাত এক সময় রক্তাক্ত হয়েছিল, সেই হাসানুল হক ইনুই এখন আওয়ামী লীগের কর্ণধার। আজকের কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, ১৯৭৩ সালে বায়তুল মুকাররমের এক জনসভায় ভাষণে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবের চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজাব’। যারা গোপনে বঙ্গবন্ধুর শত্রু বা বৈরী ছিল, এখন তারাই আওয়ামী সরকারের সবচেয়ে বেশী প্রিয় ও কাছের মানুষ। গত ১৫ বছর পূর্বেও জামায়াত ছিল আওয়ামী লীগের সুহৃদ বন্ধু। ১৯৮৬ সালে এরশাদের পাতানো নির্বাচনে বিএনপিকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত একসঙ্গে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। এরপরই এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াত একসঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করেছেন। এরূপ কৃৎসিত চরিত্রের প্রশংসা করার ভাষা খুঁজে পাওয়া যাবে কি? জামায়াত বিএনপিকে সমর্থন দিলে তাদের উপর আওয়ামী লীগ ক্ষুব্ধ হয়। ফলে ১৯৯২ সালে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ‘ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠন করে গোলাম আযমের ফাঁসির দাবীতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সামনে গণ আদালত বসানো হয়। সে কারণেই বিএনপি সরকার জামায়াতের গোলাম আযমকে গ্রেফতার করে। তখন বিএনপির উপর জামায়াত ক্ষুব্ধ হয়। ফলে ১৯৯৬ সালে বিএনপির বিরুদ্ধে যৌথ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে জামায়াত ও আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা গোলাম আযমকে তাসবীহ, জায়নামায ও কুরআন মাজীদ উপহার দিয়ে দো‘আ নেন। এই হল আমাদের দেশের সেক্যুলার ও ইসলামী রাজনীতির প্রকৃত চরিত্র। ক্ষমতার মোহে কে স্বৈরাচার, কে দেশদ্রোহী, কে যুদ্ধাপরাধী, কে সন্ত্রাসী পরস্পরকে চিনতে পারে না। সময়ে সবাই একাকার হয়ে যায়।
১৯৯৬ সালে বিএনপির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও জাতীয় পার্টি যুগপৎ আন্দোলন করে। দেশে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ফলে বিএনপির পতন হয়। সেই জামায়াতই আজ বিএনপির প্রাণের বন্ধু আর আওয়ামী লীগের জানের শত্রু। সে শত্রুতা এমনই যে, আওয়ামী লীগ জামায়াত নেতাদের একে একে ফাঁসিতে ঝুলানোর আয়োজন সম্পন্ন করে ফেলেছে। ইতিমধ্যেই জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করেছে। কাজেই চলমান রাজনীতি হল ‘সঙ্গে থাকলে সঙ্গী আর বিরোধী হলে জঙ্গী’। ফলে সঙ্গীকে রক্ষা করতে এবং জঙ্গী অর্থাৎ বিরোধীকে দমন করতে মাঠে নেমেছে রাজনৈতিক নেতা নামধারী গু-ারা। এই চরিত্রহীন রাজনীতিতে বন্দী হয়ে মানুষ আজ দিশেহারা (তথ্য : তাওহীদের ডাক, মে-জুন ২০১৩)।
রাজনৈতিক অস্থিরতা :
বাংলাদেশ এখন এক মৃত্যুপুরিতে পরিণত হয়েছে। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ ও শিশু-কিশোর সবাই জীবনযাপন করছে মহা আতঙ্কে। যার মূল কারণ রাজনৈতিক অস্থিরতা। এর প্রভাব পড়েছে আইন-শৃঙ্খলা, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা প্রভৃতি সেক্টরে। বিরোধী দলের ডাকা সিরিজ হরতাল-অবরোধ এবং ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ দেশের উন্নয়ন কর্মসূচীতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। হরতালের আওতার বাইরে থাকা অ্যাম্বুলেন্সও আক্রমণ থেকে রেহায় পাচ্ছে না। আদালতের নথি, ফেরি, ট্রেন ও লঞ্চে আগুন দেওয়া হচ্ছে। সংবাদ মাধ্যমের অফিস, গাড়ি বোমা হামলার শিকার হচ্ছে। দায়িত্বপালনরত সাংবাদিকও আহত হচ্ছেন। অথচ যেকোনো মৃত্যুই বেদনার, যেকোনো নৈরাজ্যই নিন্দনীয়।
হরতাল এদেশে নতুন কোন রাজনৈতিক কর্মসূচী নয়। শোনা যায় বৃটিশ আমলে মিঃ গান্ধী এদেশের মানুষকে সর্বপ্রথম সাধারণ ধর্মঘটের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তারপর থেকে বাংলাদেশে হরতাল একটা কমন ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। যেকোন কারণে বিরোধী দল প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য হরতাল আহবান করে থাকে। এতে প্রতিপক্ষের কিছু হোক বা নাহোক। ক্ষতি হয় সাধারণ জনগণের। নেতাদের কাজ হল শুধু হরতাল আহবান করা। তারপর এয়ারকান্ডিশন রুমে শুয়ে কিংবা বসে টিভি দেখে সময় কাটান। আর সাধারণ কর্মীরা রাস্তা-ঘাটে, মাঠে-ময়দানে কিছু প্রাপ্তির লোভে জীবন বিলিয়ে দেয়। হরতাল শেষে তারা বলেন, হরতাল সফল হয়েছে। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছে। এই হল রাজনৈতিক নেতাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আসল চেহারা। এক পরিসংখ্যানে জানা যায় যে, ১৯৯১-৯৬ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে রাজনৈতিক সহিংসতায় ১৭৪ জন মারা যায়। ১৯৯৬-২০০১ আওয়ামী লীগের প্রথম শাসনামলে মারা যায় ৭৬৭ জন মানুষ। বিএনপি দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকাকালে ২০০১-২০০৭ সালে হরতাল সহ অন্যান্য কারণে মৃত্যুবরণ করে ৮৭১ জন। তত্ত্বাবধায়ক আমলে ২০০৭-০৮ সালে মারা যায় ১১ জন। এবার আওয়ামী লীগ আমলে ২০০৯ থেকে ৮ নভেম্বর ২০১৩ সাল পর্যন্ত মারা গেছে ৫৬৪ জন। হরতালের সহিংসতায় গত ২৬ অক্টোবর থেকে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত মোট ১০ দিনে নিহত হয়েছে ২৭ জন, আহত হয়েছে এক হাযারেরও বেশি। ককটেল, পেট্রোল, বোমায় অগ্নিদগ্ধ হয়েছে ৭৬ জন। এদের মধ্যে ১৩ শিশু ও তিনজন প্রতিবন্ধী রয়েছে। শুধু আগুনে পুড়েই মারা গেছে ৬ জন। ৪৯০টি যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়েছে। দেড় হাযারের বেশি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটেছে এবং উদ্ধার হয়েছে আট শতাধিক (দৈনিক সকালের খবর, ১৭ নভেম্বর ২০১৩)।
এখন আবার হরতালের আগের দিনও ভয়-ভীতি দেখানোর জন্য নানা হিংসাত্মক কর্মকান্ড চালানো হয়। এছাড়া দলের কর্মী এবং ছোট নেতারা শীর্ষ নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এ ধরনের হরতালের সহিংসতার কাজে লিপ্ত হয়ে থাকে বলে শোনা যায়। এমনও দেখা গেছে গাড়িতে আগুন দিয়ে তা নিজের মোবাইল ফোনে ভিডিও করে পাঠানো হয় নেতার কাছে। এ ধরনের কর্মকান্ড দলে ভবিষ্যৎ উচ্চপদ পাওয়ার ‘যোগ্যতা’ হিসাবে বিবেচিত হয়। শুধু বিরোধী দল নয়, ক্ষমতাসীন দলের অনেক কর্মীর একই ধরনের মানসিকতা রয়েছে। পুরান ঢাকায় দর্জি দোকানের কর্মচারী বিশ্বজিত হত্যার ঘটনা যার জাজ্বল্য প্রমাণ। যে রাজনীতি কল্যাণের কথা চিন্তা না করে মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করে এবং দলের ‘ভাল’ পদ পাওয়ার লিপ্সা দেখায়, সে রাজনীতি মানুষের কতটা কল্যাণ বয়ে আনতে পারবে?
শুধু তাই নয়, যানবাহনে বোম হামলা আর অগ্নি সংযোগের কারণে সিএনজি চালক, দিনমজুর প্রাণ হারাচ্ছে, চোখ হারাচ্ছে। ককটেলের আঘাতে শিশুর হাত উধাও হয়ে যাচ্ছে। মিডিয়ায় বাবার পোড়া বুকে ১৮ মাসের ঘুমন্ত মেয়ে মরিয়মের ছবিটি দেখে দেশের মানুষ প্রশ্নবিদ্ধ, আসলে রাজনীতি কার জন্য?’ যদিও রাজনীতিবিদরা বলে থাকেন, দেশ ও জনগণের স্বার্থরক্ষায় তাদের রাজনীতি। কিন্তু এ রাজনীতি যদি চলন্ত বা স্থির বাসে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়, যদি হয় সিএনজি চালিত অটোরিকশায় পেট্রোল বোমা ছুড়ে চালককে জীবন্ত দগ্ধ করা, যদি হয় রাস্তাঘাটে ককটেল রেখে শিশুসহ পথচারীদের ঝলসে দেওয়া, তাহলে সেই রাজনীতি দেশ ও মানুষের অভিশাপ।
অর্থনৈতিক ক্ষতি :
যে কোন দেশের সার্বিক উন্নতির পূর্বশর্ত হ’ল অর্থনৈতিক উন্নয়ন। আর সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নতির পূর্বশর্ত হচ্ছে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমাদের দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার নামে চলছে রাজনৈতিক বিপর্যয়। এতে দেশ ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছে। এক দিনের হরতালে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির কী ক্ষতি হচ্ছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। যদিও ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (ডিসিসিআই) এক পরিসংখ্যানে বলেছে, এক দিনের হরতালে ক্ষতি হয় ১ হাযার ৬০০ কোটি টাকা। বিজিএমই-এর তথ্য মতে, একদিনের হরতালে পোশাক খাতে ক্ষতির পরিমাণ ১৪০ কোটি টাকা। পরিবহণ মালিকদের মতে, গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকায় ১ দিনে কমপক্ষে ২৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। ক্ষয়-ক্ষতির হিসাব কম-বেশি যেটাই হোক, হরতাল দেশের অর্থনীতির মেরুদ- ভেঙে দিচ্ছে। গাড়ি-ঘোড়া চলছে না। আমদানী-রফতানী বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এখন দফায় দফায় টানা তিন, চার দিন কিংবা এক সপ্তাহ অবরোধ কর্মসূচীতে দেশের অর্থনীতি সর্বনাশের দিকে এগিয়ে চলেছে। একদিকে যেমন কৃষকের কষ্টের ফসল নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে হু হু করে বাড়ছে দ্রব্যমূল্য। শিল্প, কল-কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আগের হরতালের চেয়ে এখন ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশী।
সম্ভাবনাময় গার্মেন্টস শিল্পে গত কয়েক বছরে নানা বিপর্যয়ের পর এখন রাজনৈতিক অস্থিরতা ও হাঙ্গামায় অবস্থা শোচনীয়। হরতালের কারণে রফতানিযোগ্য গার্মেন্টস পণ্য যথাসময়ে শিপমেন্ট করা সম্ভব হচ্ছে না। বিলম্বিত সরবরাহের কারণে বিদেশী আমদানিকারকরা বিরক্ত হচ্ছে। ইতিমধ্যে তারা বাংলাদেশের বিকল্প গার্মেন্টস রফতানিকারক দেশের সন্ধানে রয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার কারণে গার্মেন্টস ক্রেতারা বাংলাদেশে এসে এয়ারপোর্ট থেকে আবার ফিরে গেছে। এমন ঘটনা হরদম ঘটছে। এভাবে দেশীয় অর্থনীতির অন্যতম অনুষঙ্গ গার্মেন্ট শিল্পের সম্ভাবনার দুয়ারগুলো বন্ধ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে ক্ষতি :
শিক্ষাই জাতির মেরুদ-। ছাত্ররাই জাতির ভবিষ্যৎ। এই ভবিষ্যৎ নাগরিকদেরকে গড়ে তোলার প্রধান কারিগর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু আজকে সেই শিক্ষাঙ্গন নানা সমস্যায় জর্জরিত। গণতন্ত্রের অশুভ থাবা, বস্তাপচা রাজনীতির হিংস্র ছোবলে শিক্ষাঙ্গন কলুষিত। তথাকথিত ছাত্র রাজনীতির নামে ছাত্র নেতারা শিক্ষাঙ্গনে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ও বড় বড় কলেজগুলোতে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারের নামে সাধারণ শিক্ষার্থীদের হয়রানি, শারীরিক ও মানসিক টর্চার, চোরাগুপ্তা হামলা, হাত-পায়ের রগ কর্তনসহ হত্যার মত জঘন্য কাজ তারা করে যাচ্ছে। এহেন অবস্থায় ছাত্রদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্ট কালের জন্য ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীরা সেশনজটে পড়ছে এবং তাদের লেখা-পড়ায় বিঘ্ন ঘটছে। রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের আধিপত্য বিস্তার ও ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কোমলমতি ছাত্রদের হাতে নির্দ্ধিধায় অস্ত্র তুলে দিচ্ছে এবং তাদেরকে ব্যবহার করছে।
একদিকে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সব পরীক্ষা শেষ করার জন্য নির্বাচন কমিশনের তাকীদ ও সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হল ভ্যাকান্ট করার পায়তারা, অন্যদিকে দাবি আদায়ে বিরোধী দলের লাগাতার হরতাল-অবরোধ ও অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা। এই দুই মিলিয়ে পরীক্ষার সময়সূচী নিয়ে বিপাকে পড়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ। আর এই পরীক্ষার প্রস্ত্ততি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে প্রথম শ্রেণী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রেণী ও বর্ষে অধ্যয়নরত দেশের প্রায় সাড়ে ৩ কোটি শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকরা। কারণ এবারে জেডিসি ও জেএসসি নামে বড় দু’টি পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে, একের পর এক হরতাল-অবরোধের মধ্যে। ফলে নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হয়নি। দেশের সরকারী ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েরও বেহাল অবস্থা। বারবার পরীক্ষার সিডিউল পরিবর্তন করা হচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের মানসিক মনোবল হারিয়ে হতাশা ও দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। অভিভাবকগণও তাদের সন্তানদের অনাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্নে দিন কাটাচ্ছে। হরতালের কারণে নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে স্কুলেও যেতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। আর শিক্ষার্থীরা না আসায় পড়াতেও পারছেন না শিক্ষকরা। সিলেবাসও শেষ হচ্ছে না।
No comments